Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

জেলার ভূ-সম্পত্তির বিভাজন এবং নতুন জমিদারের ইতিহাস

জেলার ভূ-সম্পত্তির বিভাজন এবং নতুন জমিদারের ইতিহাস

সম্পত্তির স্থায়ী বন্দোবস্তের ফলস্বরূপ ছোট জমিদারগণ বড় জমিদারগণের স্থান দখল করে। এই সমস্ত ছোট জমিদাররা তাদের আধিপত্য অন্যের উপর বাড়াতে থাকে এবং একের পর এক জমিদারি এবং সম্পত্তি ভোগ দখলের শর্ত ক্রয় করতে থাকে। অবশেষে তারা সব সম্পত্তি একত্র করে একটা বিশাল তালুকে রূপান্তর করে। এই সমস্ত তালুক স্বভাবতই পুরাতন জমিদারদের থেকে ভিন্ন ছিল। তাদের তালুকগুলো দৃঢ় ছিল না এবং এক একটা তালুক দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত ছিল। প্রতিটি তালুকের মালিক বড় বড় জমিদারের মত বিখ্যাত ছিল। বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ক্ষমতা প্রয়োগে অর্জিত আলাদা আলাদা তালুকের একটা সংগ্রহই হল বর্তমান জমিদারের তালুক। বস্ত্ততপক্ষে, জমিদারি তখনকার দিনে সামাজিক অবস্থানের চেয়ে পেশা হিসেবে বেশি গুরুত্ব পেত। ঐ সমস্ত নতুন আবির্ভূত বড় জমিদারদের মধ্যে যশোরে নড়াইল পরিবার নামে একটা মাত্র জমিদারি ছিল। এছাড়াও অনেক জমিদার ছিল যাদের ভূমি যশোরে ছিল এবং বসবাস করত অন্য জেলায়।

যশোরের উপ-বিভাগ সৈয়দপুর
এই উপ-বিভাগের সবচেয়ে উলে­খযোগ্য ভুমি হল পরগনা সৈয়দপুর। এই ভূমি যশোরের দুই জমিদারের মধ্যে বিভাজন করে দেয়া হয়। একজন হল যশোরের রাজা এবং অন্যজন হল ট্রাস্ট স্টেটের জমিদার। এই উপ-বিভাগের অন্য আরেকটি উলে­খযোগ্য অংশ ছিল পরগনা শাহুজিয়াল। পূর্বে এই অংশ নাটোর রাজের অধিকারে ছিল যা স্থায়ী বন্দোবস্তের পরপরই বিক্রি করে দেয়া হয়। তবে এই জমিদারির পুরোটাই বিক্রি করা হয়নি। ‘ডিহির’ নামে একটা ছোট অংশ বিক্রি করা হয়েছে। এই অংশে কিছু গ্রাম ছিল যেগুলো একে অন্যের সাথে সংযুক্ত ছিল না। ডিহিরগুলোর মধ্যে যশোরে বড় ডিহি ছিল ‘ডিহি আরপারা’ যার মধ্যে চৌগাছা অবস্থিত ছিল। গোবরডাঙ্গার  কেলারাম মুখার্জি তার মালারাম কিশোর চ্যাটার্জের নামে ঐ ডিহি কিনে নেন। কেলারামের দুই ছেলে কালীপ্রসন্ন এবং বদ্যনাথের মধ্যে ঐ ডিহি বংশধরসূত্রে ভাগ হয়। বদ্যনাথ উত্তরাধিকারী রেখে মারা যান এবং কালীপ্রসন্নের ছেলে সারদা প্রসন্ন মুখার্জী ঐ মুলকের মালিক হন। তিনি ১৮৬৯ সালে মারা গেলে স্টেট কোর্টের কাছে চলে যায়। জেলার দক্ষিণ অংশের চেয়ে গোবরডাঙ্গা পরিবারের বেশি ভূসম্পত্তি ছিল। তাদের নদীয়াতে উলে­খযোগ্য পরিমাণ ভূসম্পত্তি ছিল এবং ২৪ পরগনাতেও  অল্প পরিমাণ ছিল। অন্য আর একটা ‘ডিহি’ হল ‘ডিহি ফুলবাড়িয়া’।

মুর্শিদাবাদে একটা দেবমূর্তি ছিল। সম্পত্তির স্থায়ী বন্দোবস্তের অনেক আগেই এটা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। নাটোরের অবশিষ্ট ভূ-সম্পত্তি যখন খোয়া যায় তখন এটা পুনরুদ্ধার হয় এবং তার অংশবিশেষ নাটোর পরিবারের দখলে ছিল। ডিহি কানেশপুর কোটচাঁদপুরের একটা অংশ ছিল। যখন নাটোরের ভূ-সম্পত্তি থেকে ডিহি কানেশপুর এবং ডিহি স্বরূপপুর বিক্রি হচ্ছিল তখন ঠাকুর পরিবারের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা গপীমোহন ঠাকুর তা কিনে নেন।কোলকাতার বিখ্যাত ঠাকুর পরিবার এসেছে এক মিশ্র ব্রাহ্মণ পরিবার থেকে এবং এই পরিবারের নাম পির আলীর ব্রাহ্মণ পরিবার। তারা মূলত যশোর জেলার রাজহাটের কাছে নরেন্দ্রপুরের অধিবাসী ছিল। পির-আলী খান ছিলেন মোহাম্মাদ (সা:) বংশের অন্তর্ভুক্ত, যিনি সরকারের সহযোগিতায় অথবা যশোরের রাজার সহযোগিতায় জেলায় অনেক কাজ করেছেন। গোপীমোহনের পর ছয়টি প্রজন্ম অতিবাহিত হলো। শেষ শতাব্দীর শুরু বা মাঝে ঠাকুর পরিবারের পঞ্চানন যশোর ত্যাগ করে ফোর্ট উইলিয়াম এর নির্বাচিত স্থানে বাড়ি তৈরি করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। যিনি ব্রিটিশদের কাজে যোগদান করেন এবং তখনই তার মূল নাম ঠাকুর করা হয়। তখন অবশ্য ইংরেজরা আসলে ব্রাহ্মণকে ঠাকুর উপাধি দেন। তার পুত্র জয়রাম ঐ সম্পত্তি ফোর্ট উইলিয়ামকে দিয়ে দিলেন এবং এর বিনিময়ে প্রচুর পরিমাণে ক্ষতিপূরণ নিলেন। জয়রামের পুত্র দর্পনারায়ণ ব্যবসা বাণিজ্য এবং সুদে টাকা দিয়ে প্রচুর সম্পত্তি অর্জন করেন। তিনি চন্দ্রনগরে ফ্রেন্সদের সহযোগিতা করে অনেক সম্পদ অর্জন করেন। যখন নাটোরের স্টেট বিক্রি হতে লাগলো তখন তিনি রংপুরের একটি বড় পরগনা কিনে নিলেন। তার পুত্র গোপিমোহন যিনি ফ্রেন্সদের সহযোগিতা করতেন, তিনি নাটোর রাজের বিভাজিত স্টেট কিনে নিলেন। বঙ্গের প্রায় সর্বত্রই ঠাকুর পরিবারের স্টেট ছিলো। এর ফলে তারা একটা অন্যতম জমিদারি পরিবারে পরিণত হলেন। তবে যশোরে তাদের সম্পত্তি বেশী ছিলো না। তাছাড়া কোটচাঁদপুরের নিকটে দু’টি ডিহি ছিলো যা পত্তনিতে দেয়া হয়েছিলো। তারাক রসুলপুরের জমিদারির অর্ধেক অংশ তাদের দখলে ছিলো। ওই অংশে অনেক গ্রাম ছিলো এবং ভৈরবের উত্তর পাশও এর অংশ ছিলো। ভৈরব খাল যশোর এবং আফরার মধ্যে অবস্থিত। ওই খালের দুই পাশে আফরা এবং গোফরা অবস্থিত ছিলো।

যশোর উপবিভাগের পূর্ব এবং উত্তর পূর্ব পরগণার অংশ ইমাদপুর এবং ইছাফপুর দখল করে নিয়েছিলো। চাঁচড়ার রাজার জমিদারীর অংশ বিক্রি হয়েছিলো যখন তার সম্পদ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিলো। ওই সম্পত্তিগুলোর মালিক এখন বিভিন্ন জমিদার। জমিদারদের মধ্যে প্রধান ছিলেন বাগচাড় বাবু আনন্দ চন্দ্র চৌধুরী। দক্ষিণপাশের অনেক জমি তার দখলে ছিলো। তার জমিদারি কাচারি তারাগঞ্জে অবস্থিত ছিলো। এর উত্তরাঞ্চলে নওয়াপাড়া বাবুর কিছু জমিদারি ও কিছু পাটনী ছিলো। এর দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে তরাফ রসুলপুর নড়াইল বাবুর পাটনী ছিলো।

 

ঐ জমিদারির ক্ষমতার একটা অংশ রাজার কাছে চলে যায় এবং অন্য অংশ ঠাকুরপরিবারে চলে যায়। যশোরের কাছে রাজার কিছু সম্পত্তি ছিল এবং এর একটা বড়অংশ ট্রাস্ট এস্টেটের ছিল। রামনগর এবং চাঁচড়ার মাঝে অবস্থিত জমি রামনগর বাবুর অধীনে ছিলো। মনিরামপুরের দিকেও তাদের সম্পত্তি ছিলো। আনন্দচন্দ্র চৌধুরীর যশোরের নিকটে কিছু সম্পত্তি ছিলো। এবং তার চাচাতো ভাই রায় রাধাচরণেরও সম্পত্তি বিভিন্ন মালিকের অধীনে ছিলো। যশোর উপবিভাগে এককভাবে কেউ সম্পত্তি একত্র করতে পারেনি। সৈয়দপুর এস্টেট রাজা এবং ট্রাস্ট এস্টেটের অধীনে ছিলো। এছাড়া এর উপ-বিভাগের বাকি সম্পত্তি বিভিন্ন মালিকের অধীনে ছিলো। ঝিনাইদহ উপবিভাগের বেশিরভাগ অংশ পরগনার মধ্যে ছিলো। পরগনা থেকেই চাকলা মুহাম্মদশাহীর উৎপন্ন হয়। ঝিনাইদাহের জমিদারির ইতিহাসই বর্তমানে মুহাম্মদশাহীর ইতিহাস। এটা বলা হয় যে, মুহাম্মদশাহী নলডাঙ্গার রাজার পৈত্রিক সম্পত্তি ছিলো। নলডাঙ্গার বাড়ি তিনভাগে বিভক্ত হলো। এর তিনভাগের এক অংশ নলডাঙ্গার রাজার অধীনে ছিলো এবং বাকী দুই অংশ নড়াইল বাবুর অধীনে চলে যায়।

এ উপবিভাগের সম্পত্তিগুলো এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। ঐ সম্পত্তিগুলো নড়াইল বাবু এবং নলডাঙ্গার রাজার মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। পশ্চিমাংশের সম্পত্তি নড়াইল বাবুর অধীনে ছিলো এবং পূর্ব অংশ নলডাঙ্গার রাজার অধীনে ছিলো। নড়াইল বাবু বেশিরভাগ সম্পত্তি নিজেই রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। অন্যদিকে নলডাঙ্গার রাজার বেশিরভাগ সম্পত্তি পত্তনীতে দিয়ে দিলেন। নলডাঙ্গার রাজার ব্যবসার কেন্দ্র ছিলো নলডাঙ্গায় এবং অন্যদিকে নড়াইল বাবু চাকলা কাচারিতে বসে তার সম্পত্তি দেখাশুনা করতেন। চাকলা কাচারি ঝিনাইদহ থেকে দুই মাইল পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। যতদিন তারা পরগনা জয় করতে পারেনি ততদিন চাকলা কাচারি ঝিনাইদহর অধীনে ছিলো। মাগুরা উপ-বিভাগ সর্ব পশ্চিম ও উত্তরে মুহাম্মদশাহী পরগনার মধ্যে পড়েছে। মাগুরার পূর্বাঞ্চল বা মোহাম্মদপুরের চারিদিকে অবস্থিত তা মূলত পরগনা সদর নামে পরিচিত। এখান থেকে নদী পেরিয়ে ফরিদপুর  জেলা। এটা পরগনার একটা অংশ এবং নাটোর রাজের ভাঙ্গনের পর তা বিক্রি করা হয়। পাল চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা কৃষ্ণচন্দ্র পাল ঐ অংশ ক্রয় করে নেন। কৃষ্ণপাল রানাঘাটে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন। রানাঘাটে একজন ব্রাহ্মণ ছিল। রানাঘাটের সেই ব্রাহ্মণের একটা ছোট ব্যবসা ছিল। ঐ ব্রাহ্মণের ছোলা নামে শষ্যের অনেক মজুদ ছিল। কিন্তু তার মনে হল পোকামাকড় শষ্যগুলো নষ্ট করে ফেলেছে। ব্রাহ্মণ তার শষ্যগুলো বিক্রি করতে চাইলে কৃষ্ণপাল তা কিনে নিলেন। পরবর্তীতে দেখা গেল কৃষ্ণপালের প্রচুর লাভ হল কারণ পোকায় শষ্যের সামান্য অংশ নষ্ট হয়েছিলো। কৃষ্ণপাল একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন এবং তার প্রচুর সম্পদ ছিল। তিনি মূলত লবণের ব্যবসা করতেন। বোর্ড অব রেভিনিউর নিকট তিনি লবণ দিয়ে প্রচুর লাভ করলেন। অবশেষে তিনি জমিদারি প্রথা চালু করলেন এবং পরগনা সদর কিনে নিলেন। কৃষ্ণপালের পরিবার নদীয়ায় রানাঘাট এবং বনগাঁ এর নিকটবর্তী অনেক ভূমি কিনে নেন। বেশ কিছুদিন ঐতিহ্যের সাথে সম্পদ দখলে রাখার পর তারা এগুলো হারাতে থাকেন।

কৃষ্ণচন্দ্রপালের অনেক উত্তসূরী ছিলো এবং তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে প্রথম দ্বন্দ্ব তৈরি হলো একটা ছাগল নিয়ে। এই দ্বন্দ্ব তাদের পরিবারের মধ্যে বিভেদ ঘটায়। তারা এই বিভেদ নিয়ে কোর্টে মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে তাদের সমস্ত সম্পদ হারায়। একটা মামলা অবশিষ্ট ছিল যা ১৮২১ সাল থেকে ১৮৫০ সাল পর্যন্ত চলমান ছিলো। ঐ পরিবারের বৈদ্যনাথ নামের এক ব্যক্তি মামলা পরিচালনা করে সম্পদের একটা অংশের মালিক হন। মি. মেকিনটোস পাল পরিবারের বিপরীতে মামলা পরিচালনা করে তার পক্ষে রায় পান।ঐ মামলাগুলো সর্বশেষ অবস্থা এমন হলো যে মি. মেকিনটোস পরগনা সতর এর অর্ধেক সম্পদের মালিক হলেন। বাকি অর্ধেক সম্পদ ঠাকুর দাস ঘোসাইন নামে অন্য ব্যক্তি ১৮৬১-১৮৬২ সালে কিনে নেন। মি. ম্যাকিনটোস তার অর্ধেক সম্পত্তি ফরিদপুর জেলার ডালারে গোবিন্দ সাহা নামক এক বণিকের কাছে বিক্রি করলেন। তারপর সেখানে তিনি জমিদার পরিবার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ঠাকুর দাস ঘোসাইন ছিলেন শেরামপুর পরিবারের ঘোসাইনদের একজন সদস্য। সেখানে কিছু সম্পত্তির তিনি মালিক ছিলেন। এই পরিবার ঠাকুর দাসের পিতামহ রামনারায়ণ ঘোসাইনের সময়কাল পর্যন্ত ধর্মচর্চা করত। তারপর সে তার বাবার উদ্দীপনায় ব্যবসা শুরু করেন। শেরামপুরে ডেনমার্কের বণিকদের সাথে ব্যবসা করে প্রচুর টাকা উপার্জন করেন। তারপর তিনি বিভিন্ন জমিদারি যেমন বর্ধমান, পূর্ণা এবং মিডনাপুর ক্রয় করেন। তার পুত্র কমলচাঁন সরকারের কমিশনারের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে প্রচুর টাকা উপার্জন করেন এবং হুগলিতে প্রচুর জমি ক্রয় করেন। কমলচাঁনের পুত্র ঠাকুরদাসও তার বাবার মত একই পদ্ধতিতে টাকা উপার্জন করেন। পাল চন্দ্র যখন অর্থ সংকটে পড়েন তখন ঠাকুরদাস সাতর কিনে নেন। মোহাম্মদপুর তার কাচারির অংশ ছিল। পাল চন্দ্রের পরিবারের কৃষ্ণচন্দ্রের ভাই শ্রী গোপালই একমাত্র ব্যক্তি ছিলেন যিনি তার দক্ষতা ও ভাল ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবারের দুর্যোগ মুহূর্তে টিকে ছিলেন। শ্রী গোপাল তার জমিদারীর ক্ষেত্র বাড়াতে থাকেন এবং এক সময় বড় জমিদারি লাভ করেন। নদীয়া উপবিভাগ রানাঘাট এবং বনগাঁ তার মুলক ছিল। তারা যশোরের পশ্চিম সীমামত্ম দিয়ে যশোরে প্রবেশ করেছিলেন। মাগুরার মধ্যে তারাফ নোহাট্টা উলে­খযোগ্য জমিদারি ছিল। যশোরের কাছেই বাগচরের আনন্দচন্দ্র চৌধুরী এ জমিদারির সালিস ছিলেন। তার পরিবার মূলত বর্ধমান থেকে এসেছে। একশ বছর আগে তার দাদা কাবলরাম যশোরে চলে আসেন। তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি এবং তার পুত্র প্রচুর সম্পত্তি অর্জন করেন এবং যশোরের নিকটে ইফাদপুর এবং ইমাদপুর পরগনায় প্রচুর সম্পত্তি ক্রয় করেন। কাবলরামের কনিষ্ঠ পুত্র গুরম্নপ্রসাদের ছোট ছেলে আনন্দচন্দ্র ঐ পরিবারের প্রধান সদস্য ছিলেন। তিনি যশোরের রাজার ট্রেজারার হিসেবে ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেন। ট্রেজারের কাজ ছিল রাজার ভূমি ধার দেওয়া এবং এ কাজ করে তিনি প্রচুর সম্পদের মালিক হন। একই সময়ে তিনি ব্যবসা করেও প্রচুর সম্পদের মালিক হন। তারপর ১৮৪৭ সাল থেকে ১৮৬৫ সাল যশোরের কালেক্টরেটের ট্রেজারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। কালেক্টরেটের ট্রেজারার এমন একজন ব্যক্তি যার কাছে অভাবগ্রস্থ জমিদাররা চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে আবেদন করেন। তাদের প্রয়োজনীয়তা থাকে তীব্র। আর ট্রেজাররা সেই সুযোগ ব্যবহার করেন। আনন্দচন্দ্র তার ব্যবসা এবং ভূমির ধার দিয়ে একজন সম্পদশালী ব্যক্তিতে রূপান্তরিত হন এবং পরবর্তী সময় অনেক স্টেট ক্রয় করে নেন। তিনি ১৮৪৪ সালে তারাফ নোহাট্টা ক্রয় করে নেন। তিনি ইসাফপুর পরগনায়ও কিছু জমি ক্রয় করে নেন। মাগুরা সাব-ডিভিশনের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল পরগনা ইসাফপুরের মধ্যে পড়েছে। ঐ এলাকার ভূমি কয়েকজন জমিদারের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে নওয়াপাড়ার বাবু ছিলেন সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং চন্দ্রার আলংমোহন দেব রায় ও একজন মুখ্য জমিদার ছিলেন।

নড়াইল উপ-বিভাগ

নড়াইলের উত্তরের অর্ধাংশ জুড়ে ছিল পরগনা নলদী। পরগনা নলদী মাগুরায় গিয়ে পড়েছে। এই পরগনার মালিক পাইকপারা সিং ১৭৯৮ সালে এটা ক্রয় করেন। প্রাণ কৃষ্ণ সিং যে পরিবারের সদস্য সে পরিবার বাংলার রাজনীতিতে খুব প্রভাবশালী ছিলো। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হারকৃষ্ণ সিং, তিনি মোহমেডান সরকারের সময় প্রচুর সম্পত্তি অর্জন করেন। প্রাণকৃষ্ণ সিং ছিলেন বাংলার নওয়াব আলিবর্দী খান ও সিরাজ-উদ-দৌলার অধীনে রাজস্ব অফিসার। যখন ব্রিটিশরা রাজস্ব খাত তাদের দখলে নিয়ে নিল তখন তিনি ব্রিটিশদের রাজস্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র দিয়ে সাহায্য করেন। তখন তিনি হুগলিতে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পান। তার পরিবার বছরে ৩,৬৯৮ রূপি পেত। প্রাণকৃষ্ণের অন্য এক ভাই গঙ্গাগোবিন্দ উচ্চ বেতনে ওয়ারেন হেস্টিংসের সাথে কাজ করত। জেলার প্রায় অর্ধেক অংশেই তার পরিবারের দখলে ছিল। নলদি মুলুক বাদে যশোরে তাদের তেমন কিছু ছিল না। প্রাণকৃষ্ণের পুত্রের নাম ছিল কৃষ্ণচন্দ্র সিং। কৃষ্ণচন্দ্র সিং লালাবাবু নামে বেশি পরিচিত ছিল। তিনি ধর্মীয় খাজনা তোলেন এবং জেলার উত্তর পশ্চিমে বসবাস শুরু করলেন। সেখানে তিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। বৃন্দাবনে তিনি একটা মন্দির তৈরি করলেন। তার স্ত্রী বাণীকামত্মীও সামাজিকভাবে পরিচিত ছিলেন। লাল বাবুর ছেলের নাম শ্রী কারয়েন প্রতাপ চন্দ্রর সিং। তিনি ১৮৬৬ সালে মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার বিশাল সম্পত্তি কোর্টের আয়ত্তে চলে যায়। তারা তাদের মূল কার্যক্রম পরিচালনা করত মোহাম্মদপুর বসে, যখন মোহাম্মদপুর পে­গ দ্বারা আক্রান্ত হল, তখন তারা তাদের কাচারি লীপাসায় হস্তান্তর করল। নলদী পরগনায় সম্পত্তি ভোগ দখলের ব্যতিক্রমধর্মী শর্ত ছিল।

যশোরের প্রতিটি অংশে প্রজাদের মধ্যে সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা চাষ করার জন্য খুব উৎসাহী ছিল। তারা ‘জুম’ চাষ করত। তারা নিজেরাই জমি চাষ করত। তবে যে জমি তারা চাষ করত সে জমির মালিকানা তারা কখনও দাবী করত না। অন্য একটা শ্রেণীর প্রজা ছিল যারা নিজেরা চাষ করত না কিন্তু অন্যদের দিয়ে করাত। তারা মূলত একটা গ্রাম বা একটা গ্রামের অর্ধেক জুড়ে বিস্তৃত ছিল। নড়াইল এবং মাগুরা অংশের এই শ্রেণীর লোকদের ‘জোতদার’ এবং জেলার পশ্চিমাংশে ‘গাতীদার’ বলা হত। জোতদার এবং গাতীদাররা নলদীতে তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে লাগল; তারা জমিদারদের কম ভাড়া দিত এবং জমিদাররা তাদেরকে খুব একগুয়ে মনে করত। পরগনা নলদীর ভৌগোলিক সীমার মধ্যে তিনটি স্টেট ছিলঃ তরাফ নড়াইল, তরাফ কালিয়া এবং গোবরা। নড়াইল পরিবারের অনেক পাটনী, ফার্ম, জুমা, বাগান এবং সব ধরণের রায়তী সত্ত্ব ছিল। নড়াইল উপ-বিভাগের পূর্ব দিকের পরগনায় মনিরামপুর নামে একটা বড় জমিদারী ছিল।

এর বিস্তৃতি পরে ফরিদপুর জেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এর মূল কেন্দ্র ছিল লক্ষেপাশা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে চাঁদপুরে। মনিরামপুরে যে পরিবারের অংশ ছিল তার প্রথম সদস্য ছিল প্রতিরাম। প্রতিরাম এবং তার ভাই রাম ধান ব্যবসা করে প্রচুর সম্পত্তি অর্জন করেছিল এবং সেখানে একটি জমিদারি কিনে নেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কোলকাতায় অনেক দামী কাপড়ের গোডাউন ছিল। একসময় গোডাউনটি আগুনে পুড়ে যায়। তখন সরকারী কর্মকর্তারা অবশিষ্ট কাপড়গুলো বিক্রি করে দেয়। ঐ গোডাউনের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুইজন সরকারের নিকট হতে ১৬ হাজার রূপি দিয়ে কাপড়গুলো ক্রয় করে নেয়। যখন তারা কাপড়গুলো বিক্রি করতে গেল তখন দেখল যে পোড়া কাপড়গুলোর নিচে প্রচুর পরিমাণে ভাল কাপড় আছে যার মূল্য ৬-৭ লাখ রূপির মত। শিবরাম নাটোর রাজের দু’টি পরগনা ক্রয় করে। তখন তেমন দামী কোন জমিদারি ছিল না, শিবরাম সরকারের কাছ থেকে কোন আশানুরূপ ফল না পেয়ে প্রিট রামের কাছে ১৯,০০০ রুপিতে পরগনা বিক্রি করে দেয়। প্রিটরাম বছরে ১০০০ রুপি কিস্তি দিয়ে গরগনা ক্রয় করেন। কলকাতায় প্রিটরামের বড় ব্যবসা ছিল। তিনি প্রচুর পরিমাণ বাঁশ, কাঠ এবং মাছ কলকাতায় রপ্তানী করত এবং তার ব্যবসা লাভ থেকে বছরে এক দুইবার সরকারের চাহিদা পূরণ করত। আর ঠিক ঐ সময় নদীটি খুলে দেয়া হল এবং নদীর স্রোতে পলি এসে জমিগুলো উর্বর করতে লাগল। পরগনাটি ধীরে ধীরে উর্বর হয়ে উঠল এবং এটা একটা দামী অবস্থানে চলে গেল। প্রিটরাম তার পুত্র রাজচন্দ্রের সহায়তায় সফলতা লাভ করেন। তাদের পরিবার রংপুরে একটা বড় এস্টেট-এর মালিক হন। তারা ২৪ পরগনাতেও প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন। তাই যেখানে তারা বসবাস করত সেখানে তাদেরকে ‘জান বাজার’ জমিদার বলা হত। প্রিটরাম এবং রাজচন্দ্র দুইজনই কলকাতার ইংলিশ কোয়ার্টারে অনেক বাড়ি তৈরি করেছেন।

 

পশ্চিম নড়াইল শ্রিধরপুর বসুর ছোট জমিদারী ছিল। তাদের পরিবারের উৎপত্তি বেশি দিনের নয়। তারা ব্যবসা বাণিজ্য করেই মূলত টাকা উপার্জন করত। ১৮৪৭ সালের পূর্বে ঐ পরিবারের বড় ছেলে পঞ্চনান কালেক্টরের ট্রেজারার ছিল। শ্রীধরপুর এবং কালীগঞ্জের নিকটেই তাদের ছোট জমিদারি ছিল, সেখানে তারা একটা স্কুল এবং ওষুধের দোকান ছিল। ভৈরব নদীর তীর ঘেঁষে শ্রীধরপুরের দিকে একটা রাস্তা তৈরি করল। খুলনা উপ-বিভাগে খালিশপুর খুলনার পশ্চিমে এবং মহেশ্বরপাশা উত্তরে অবস্থিত। এর বেশির ভাগই ট্রাস্ট স্টেট-এর মধ্যে পড়েছে। ডাকাতিয়া এবং পাবলা বিল এই স্টেটেই অবস্থিত।

ভৈরব নদীর তীরে পরগনা বেলফুলিয়া অবস্থিত। এই পরগনার কথা ১৭৯৯ সালে উলে­খ করা হয়েছিল। পরগনাটি তখন বিক্রি করা হয়েছিল এবং এটা বিভাজন করা হল। তখন সেই বিভাজিত অংশগুলো আবার একত্রিত করা হল। ঐ পরগনার একট বড় অংশ দত্ত চৌধুরীর অধিকারে ছিল। তিনি সুলতানপুরেরও মালিক ছিলেন। হোগলাতে প্রসাদ রায়ের অনেক জমি ছিলো।

পসর নদীর পূর্ব দিকে হোগলা পরগনা অবস্থিত। ‘হোগলা’ নামটা এসেছে সুন্দরবনে নদীর তীরে হোগলা নামক নল-খাগড়া থেকে। দত্ত চৌধুরীর পরিবারের লোকজন তাদের অংশ নিয়ে বিরোধ বাধিয়ে দিল। ঐ পরিবারের দুইটি অংশ ছিল-একটা অংশ পরগনার চার আনা দখল করে নিয়েছিলো এবং পরিবারের অন্য অংশ তাদের মায়ের নামে পরগনার বাকী অংশ কিনে নিল। রামনগর বাবুর চার আনা শেয়ার ছিল। তার অংশের বেশির ভাগ জমি ছিল। এই পরিবার বর্ধমানে থাকত যেখানে তাদের কিছু সম্পদ ছিল। যখন কৃষ্ণ দুলাল ঘোষ কালেক্টরের দেওয়ান হল তখন তারা এ জেলায় বসবাস শুরু করে। এখানে এসে প্রচুর টাকা উপার্জন করে এবং কয়েকটি জমিদারি কিনে নেয়। তার পাঁচ ছেলে তার জমিদারি টিকিয়ে রেখেছিলো। এছাড়া যশোর উপ-বিভাগে এবং যশোরের নিকট নড়াইলে কিছু ভোগ-দখল সম্পত্তি ছিল। তাদের প্রধান জমিদারি কাচারী মানসায় ছিল কিন্তু তাদের এস্টেট কালেক্টরের তত্ত্বাবধানে ছিলো। হোগলাতে ঐ পরিবারের চার আনা শেয়ার ছিল। এই শেয়ারে খুলনার রেইনী পরিবারের একটা অংশ ছিল। নীল চাষ করে রেইনী এবং তার বাবা এটা অর্জন করেছিল। তখন তারা খুলনার অন্য একটা বড় পরগনাও কিনে নিয়েছিলেন। তখন সাহস পরগনাটি চাঁচড়ার রাজার এস্টেট ছিল। ট্রাস্ট স্টেটেরও সোবানী নামক একটা বড় স্টেট ছিল যা সাহস পরগনার ভৌগোলিক সীমার মধ্যে অবস্থিত। এ উপ-বিভাগের সর্ব পশ্চিমের উত্তরে রামচন্দ্রপুর এবং দক্ষিণে মাল­ই অবস্থিত। এই দুইটা স্থানই রাজার স্টেটের অধীনে ছিল। রামচন্দ্রপুরের পরিবারের নাম ‘টাকী’ পরিবার। টাকী পরিবার ২৪-পরগনায় বসবাস করত। মাল­ইতে ২৪ পরগনার অন্য একটা পরিবার বাস করত যাদের ‘চৌধুরী’ বলে পরিচিত ছিল। সাতীরায় চৌধুরী পরিবারের অনেক বড় স্টেট ছিল। এই পরিবারটি বিষ্ণরাম রায় থেকে এসেছে। বিষ্ণরাম রায় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের চাকর ছিল। যখন নদীয়া স্টেট বিক্রি করা তখন বিষ্ণরাম রায় ২৪ পরগনার বুরান ক্রয় করে নেয়। বিষ্ণরামের ছেলে প্রনাথ রায় চৌধুরী জমিদারি বৃদ্ধি করতে থাকে এবং তিনি পরিবারের প্রধান হন। মাল­ই এর জমিদারি অন্য জমিদারির মত কোর্টে চলে যায় তখন যশোরের রাজা এবং সাতীরার রাজার মধ্যে মামলা চলতে থাকে। অবশেষে সাতীরার চৌধুরী পরিবার ১৮৪৮ সালে মামলায় জয়লাভ করে সম্পত্তি নিয়ে নেন। এই পরিবারের সম্পত্তির বাইরেও পরিবারের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি অর্জন করে। উদাহরণস্বরূপ উপানাথ চৌধুরী চাঁদখালী জমিদারি ক্রয় করে নেয়।

বাঘাট উপ-বিভাগ

বাঘাট উপ-বিভাগের উত্তরাংশের সুলতানপুর-খারারিয়া আথাবাংকা, মধুমতি  এবং ভৈরব এর মাঝে অবস্থিত। দত্ত পরিবারের উত্তরসূরি কাশিনাথ দত্ত একটা জমিদারি অর্জন করল। রাজস্ব বোর্ডের অনুমতিক্রমে তারা এই জমিদারির মালিক হয়। ঐ পরিবারের তিনটি শাখা পরগনায় সমান শেয়ার অর্জন করে এবং তারা আলাদা আলাদা বাউন্ডারি দিয়ে দেয়। ঐ পরিবারের তিনটি উত্তরাধিকারের মধ্যে নৃশিংঘৃ দত্ত আনন্দ চন্দ্র মিত্র এবং কালী প্রসাদ দত্তের জমিদারি কাচারি মানসা বিপরীতে মুলগরে অবস্থিত ছিল। ভৈরব নদীর দক্ষিণ পাশে চুরূলিয়া পরগনা হোগলা পরগনার সাথে মিলিত হয়েছে। গোবরডাঙ্গা পরিবারের তত্ত্বাবধানে হোগলা পরগনা ছিল। তাদেও জমিদারি কাচারী যাত্রাপুরে অবস্থিত ছিলো। রাজা রাধাকামেত্মর নিকট হতে রাজা গোপী মোহন দে ১৮১৩ সালে ঐ জমিদারি কিনে নেন। স্থায়ী বন্দোবস্তের কিছুদিন পর পরগনাটি খাস জমিতে পরিণত হয় এবং সরকার তা বিক্রি করে দেয়। গোবরডাঙ্গা জমিদারিতে রঙ্গদিয়া পরগনায় পাটনী অবস্থিত। দুলান সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে ঐ জমিদারীর মালিক হন। তিনি ছিলেন অনেক কৃপণ। তিনি সম্পদ শুধু একত্র করতেন এবং হাত খরচ দিনে আট আনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতেন। তিনি যখন মারা যান তার ছেলেরা তার সম্পদের অংশ রঙ্গদিয়া পরগনায় বিক্রি করে দেয়। বাঘাটের পূর্বাংশ এবং বাকেরগঞ্জ জেলা সংলগ্ন পরগনা সেলিমাবাদ অবস্থিত। এই পরগনার দক্ষেণাংশ সুন্দরবনে গিয়ে পড়েছে। সুন্দরবনের জমির উপর সরকার যতদিন হস্তক্ষেপ করেনি, ততদিন সেলিমাবাদের জমিদার সুন্দরবনের অনেক জমি চাষের উপযোগী করে তোলে। সেলিমাবাদ পরগনার মধ্যে প্রধান মালিক হল ঘোষাল পরিবার এবং দেব পরিবার। ঘোষাল পরিবার কলকাতায় বসবাস করত। দেব পরিবার বাকেরগঞ্জ জেলায় বসবাস করত। সেলিমাবাদের সবচেয়ে পুরাতন মালিক হল দেব পরিবার। ঘোষাল পরিবারও অনেক দিন এর মালিক ছিল। শতাব্দীর মাঝামাঝি ঘোষাল পরিবার তাদের এক পূর্ব পুরুষের কারণে পরিচিতি লাভ করে। তিনি ছিলেন ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ কোম্পানীর পরিচালক মি. ভিরেলস্ট এর কাছের মানুষ। অনেক আগের এক পূর্ব পুরুষ ঢাকার কোর্টের নওয়াব ছিল এবং তিনি দেব পরিবারের কাছ থেকে সেলিমাবাদের অর্ধেক সম্পত্তি একটা কাজ করে দেয়ার বিনিময়ে ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। স্থায়ী বন্দোবস্তের পর সেলিমাবাদের ভাড়া যখন নিয়মিত পরিশোধ হত না তখন তা খন্ড খন্ড করে বিক্রি করা শুরু হল। এই পদ্ধতিতে সমস্ত অঞ্চল ছোট-বড় অনেকগুলো স্টেটে ভাগ হয়ে গেল। বনগ্রামের বাবু মহিমাচন্দ্র রায় ঐ স্টেটগুলোর প্রধান মালিক হলেন। কারাপারা বাঘাটে অনেক প্রাচীন একটা পরিবার বসবাস করত, যার প্রধান ছিলেন একজন মহিলা। তাদের পরগনা খলিফাতাবাদে কিছু জমিদারি ছিল। ঐ জমিদারির ভূমিসমূহ বাঘাটের নিকটেই ছিল। বাঘাটের দক্ষিণে যে সমস্ত ভূমি ছিল তার বেশিরভাগই সুন্দরবনের তালুক ছিল, এই জমিগুলোর বেশিরভাগেই চাষ করা হত।

জেলার উত্তরের অংশের মত বাঘাটে ভোগ-দখলকৃত জমি ছিল না। জেলার পশ্চিমাংশে এবং পরগনা নলদীতে যেমন ছোট ছোট ভোগ-দখলকৃত সম্পত্তি ছিল, বাঘাটে তা ছিল না। জেলার দক্ষিণে জমিদাররা নয় বরং প্রজারা জমি ভোগদখল করত। সবচেয়ে বড় ভোগ-দখলকৃত সম্পত্তিকে ‘তালুক’ বলা হত। তালুকের মালিকদের ‘তালুকদার’ বলে ডাকত। তালুকদাররা প্রজা শ্রেণীর দলভুক্ত ছিল না। তাদের ভূস্বামী বলা হত। তালুকদারদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাজনা নির্ধারণ করা ছিল। তালুকদারদের অধীনে ‘‘হাওলাদার’’ ছিল, যাদের খাজনা দেয়ার পরিমাণও নির্দিষ্ট করা ছিল। তালুকদাররা হাওলাদার এবং জমিদার উভয় দলের মধ্যবর্তী একটা অবস্থানে থেকে তালুকদারী করত। তালুকদাররা নিজেদের ভোগ-দখলকৃত সম্পত্তির মধ্যেই হাওলা প্রথা এবং হাওলাদাররা তালুকদারদের অধীনস্থ দখলকৃত সম্পত্তিতে ‘নিম-হাওয়া-এসা’ চালু করে। দখলকৃত সম্পত্তির পুনরুদ্ধারের জন্য এর মূল উৎস পাওয়া যায়। একজন প্রজা ‘আবাদকারী সত্ত্ব’ অথবা ‘পুনরুদ্ধার অধিকার’ বলে একটা জমি পেয়েছিলো। যত বেশি দখলকৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার হচ্ছিল প্রজাদের মধ্যে থেকে হাওলাদার এবং হাওলাদারের অধীনস্থ হাওলাদারের আবির্ভাব ঘটল। পরগনার জমির তালুকদারা জমিদার এবং উপযুক্ত প্রজা অথবা হাওলাদারদের মধ্যবর্তী স্থান দখল করে নিলেন। সুন্দরবনের অঞ্চলগুলোকে ‘তালুক’ বলা হত এবং তাদের মালিকদের ‘তালুকদার’ নামে সবাই চিনত। এই সমস্ত তালুকদারদের একটা উলে­খযোগ্য সংখ্যকের যশোর, গোবরগঞ্জ এবং ২৪ পরগনাতে জমিদারি ছিল। এই সমস্ত তালুকদারগণ দখলকৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিলেন কারণ তারা নিজেরা অনেক ধনী ছিলেন এবং তাদের কিছু প্রজা ছিল যাদেরকে তারা সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে কাজে লাগিয়েছিলেন। এদের কারণেই স্থায়ী বন্দোবস্তের সময় কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা অর্জিত হয়েছিল। ১৮৬৯ সালে সাইক্লোনের কারণে প্রজারা তাদের সম্পদ হারিয়েছিল, তখন দখলকৃত সম্পদ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়েছিল। কিন্তু তালুকদাররা প্রজাদের যথাযথ সাহায্য সহযোগিতা করেছে এবং তাদের নিজেদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যারা খুব প্রভাবশালী জমিদার ছিল তারা প্রজাদের সমস্যাগুলো সফলভাবে সমাধান করার কারণে প্রজারা তাদের খুব প্রশংসা করেছিলো। সুন্দরবনের তালুকদারদের মধ্যে মোড়লগঞ্জের মোড়ল প্রধান ছিলেন। ত্রিশ বছর পূর্বে যেখানটা একটা জলাবদ্ধ স্থান ছিল সেখানে তিনি বিশাল জমিদারি স্থাপন করেন, তাদের সফলতা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য ছিল এবং সুন্দরবনের জমি পুনরুদ্ধারে তাদের অবদান অন্যদের সাহস যুগিয়েছিলো। তাদের জমিদারি সবার কাছে একটা ভাল মডেল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পায়। তাদের সুনাম নিজেদের অঞ্চলে, পশ্চিমাঞ্চল এবং মোড়লগঞ্জের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল।

নড়াইল পরিবার

যশোরের নতুন জমিদারদের মধ্যে নড়াইল পরিবার কর্তৃত্বস্থানীয় ছিল। ১৮৬১ সালের ২২ জুলাই হাই কোর্টের মামলার তদমত্ম থেকে একটা বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়া কালেক্টরেট থেকেও তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস সংগ্রহ করা হয়েছে। নড়াইল পরিবার, দত্ত পরিবার হতে বংশদ্ভুত। আবার দত্ত পরিবারের পূর্বপুরুষ হলেন পরেশোত্তম দত্ত যিনি গত শতাব্দীতে হাওড়ার বিরাট বালিতে বসবাস করতেন। তিনি ঐ সময় পরদেশাক্রমন করত। ফলে তাকে মুর্শিদাবাদের কাছে চাউরা গ্রামে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি একই কাজ করলে মদনগোপাল তার পরিবার নড়াইলে নিয়ে আসেন।

মদনগোপাল চাঁচড়াতে থাকাকালীন প্রচুর সম্পদের মালিক হন। কারণ তখন তিনি বাংলার নওয়াব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারপর ব্যবসা শুরু করেন। তিনি তার নিজের আবাসস্থলের জন্য মাত্র ১২ বিঘা জমি ক্রয় করেন। হাই কোর্টে রায় দেওয়া হয়েছে যে তিনি একজন ভাল মানুষ ছিলেন। যার ফলে তার ব্যবসা থেকে অর্জিত সম্পদকে আরও সুসজ্জিত করা হয়েছে। মদন গোপালের ছেলের নাম রামগোবিন্দ, রামগোবিন্দের এক ছেলে রূপরাম এবং অন্য আর এক ছেলে ছোট বেলায় মারা যায়। নাটোরের রাজার এজেন্ট হিসেবে নওয়াব এর কোর্টে রূপরাম দত্ত কাজ করতেন। এই  চাকুরি করে তিনি কিছু সম্পদের মালিক হন এবং নড়াইলে রাজার সহযোগিতায় ১৪৮ রুপি দিয়ে কিছু জমি কিনেন। ঐ জমিতেই তার আবাসস্থল নির্মাণ করেন। রূপরাম ১৮০২ সাল পর্যন্ত সেখানে বসবাস করেন। তিনি মারা যাওয়ার সময় কালীশংকর এবং রামনিধি নামে দুই পুত্র রেখে যান। কালীশংকরের ইতিহাসই হলো ঐ পরিবারের ইতিহাস। ঐ পরিবারের কাঠামো মূলত তার সম্পদের উপরই টিকে ছিল। যখন তার কর্মজীবনের যাত্রা শুরু হলো তখন তার পরিবারের নড়াইলে কয়েকশ বিঘা জমি ছিল। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার সময় যে সম্পদ রেখে গেছেন তার রাজস্বই আসত লাখ লাখ রুপি। কালীশংকর অনেক কর্মঠ ছিলেন। ব্যবসা-বাণিজ্যেও তিনি দক্ষ ছিলেন। তার বাবা তাকে রাজার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। রাজা তাকে তার দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করেন। রাজার জমিদারিতে তিনি কৃষক ছিলেন। রাজা তার ঐ জমিদারি কোন একজন উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করতে চেয়েছিলেন এবং কালীশংকরই ছিলেন  সেই উপযুক্ত ব্যক্তি।

কালীশংকরের অঢেল সম্পদের মালিক হলেন এবং একের পর এক এস্টেট ক্রয় করে চললেন। এই অঢেল সম্পদ তৈরীর পিছনে যে কারণ লুকায়িত ছিলো তা হল তিনি দেওয়ান থাকা অবস্থায় তার মনিবের অংশ নিজের পকেটে রাখতেন। তার অব্যবস্থাপনার কারণে রাজার স্টেটের রাজস্ব ঠিকমত দেয়া হত না। রাজস্ব না দেয়ার কারণে তার স্টেট বিক্রি করে রাজস্ব পরিশোধ করা হয়। এটা কালীশংকর ইচ্ছাকৃতভাবেই করেছিল। কালীশংকর তার কৌশলগত ব্যবস্থাপনার কারণে সব বাধা উৎরিয়ে তেলিহাটি, বিনোদপুর, রুপাহাট, কালিয়া এবং পোখতানী স্টেটগুলো বিক্রি করেন এবং তিনি নিজেই সেগুলো ক্রয় করে নেন।

তবে নিজের নামে ক্রয় না করে তার অধীনস্থদের নামে ক্রয় করেন। এই স্টেটগুলোর মধ্যে দু-একটা বাদে প্রায় সবগুলোই বড় ছিল। ১৭৯৫ এবং ১৭৯৯ সালে তিনি ঐ স্টেটগুলো দখলে নেন। তখন একটা ফার্ম নিয়ে কালীশংকর সমস্যায় পড়েন। কালীশংকর তখন কৌশলে তার প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করে পরিশোধ করেন এবং কালেক্টর ঐ স্টেটের সমস্যা সমাধান করেন। কালীশংকরের শুধু এই অসৎ উদ্দেশ্যের জন্য কালেক্টর তাকে নিন্দা করেন। তবে তার দোষ শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে কর আদায় করে নিজের সম্পত্তির কর দিতেন। কিন্তু তখন স্টেটের কথা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। কালীশংকর অবশেষে ১৮০০ সালে তার অসৎ কাজের ফল পেলেন। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর তাকে জেলে পাঠানো হল। সেখানে তিনি চার বছর ছিলেন। তার সম্পত্তির দু’একটা অংশ বাদে সব ‘বেনামী’ ঘোষণা হল। দু’একটা অংশ যা ছিল তা তার ছেলে রামনারায়ণের এর নামে চলে গেল। কালীশংকর তখন সংকটে পড়ল-সে কি মামলা পরিচালনা করবে, না তার ঋণ পরিশোধ করবে, আর হাতেও পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। কালীশংকর ১৮২০ সালে জেল থেকে মুক্তি পেলেন। তার দুই ছেলে রামনারায়ণ ও জয়নারায়ণ সহ তিনজন এক পরিবারে নড়াইলে বসবাস করতেন। ১৮২০ সালে কালীশংকর বেনারস যেয়ে অবসরে গেলেন। ১৮২২ সালে জয়নারায়ণ, ১৮২৭ সালে রামনারায়ণ এবং

অবশেষে ৮৫-৯০ বছর বয়সে ১৮৩৪ সালে কালীশংকর মারা যায়। মারা যাওয়ার সময় তিনি প্রায় একশ স্টেট এবং প্রায় অর্ধ লক্ষ রুপি রেখে যান। গুরুদাস নামে তার একজন উত্তরাধিকারী উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া অংশের জমির জন্য প্রায় ৪১ লাখের বেশি রুপি দাবী করেন। মুর্শিদাবাদের নওয়াবের কাছ থেকে কালীশংকর ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত হন। তখন থেকে তার পরিবার ‘দত্ত’ থেকে ‘রায়’ পরিবারে সর্বজন স্বীকৃত হয়। কালীশংকর মৃত্যুকালে তার পরিবারের দুইটি অংশ রেখে যান-রামনারায়ণের পরিবার এবং জয়নারায়ণের পরিবার। রামনারায়ণের তিন ছেলে-রামরতন, হারানাথ, এবং রাধাচরণ। জয়নারায়ণের এক বা দুই পুত্র মারা যায় এবং এক পুত্র গুরুদাসকে নিয়েই ছিল তার সংসার। রামনারায়ণের সংসার যেহেতু বড় সেহেতু তিনি কালীশংকরের সাথে সম্পত্তি নিয়ে একটি উইল করল। কালীশংকরের সম্পদের বেশীর ভাগই পড়ে রামনারায়ণের পরিবারে। এর পিছনে অন্য একটা কারণ ছিল-কালীশংকর জেলে থাকা অবস্থায় রামনারায়ণ তাকে সহযোগিতা করছে, কিন্তু অন্য ছেলে জয়নারায়ণ ধর্ম-কর্ম নিয়ে ব্যস্ত ছিল।

যখন উইল করেছিল তখন গুরুদাস ছোট ছিল। গুরুদাস তার পরিবারের সম্পত্তির শেয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলল যে, তার পরিবার কালীশংকরের সম্পত্তির অর্ধেক অংশ পাবে। গুরুদাস তার দাবিতে কোর্টে মামলা উপস্থাপন করলেন। অভিযোগ ছিল দু’টি-প্রথম অভিযোগে ছিল চুক্তিপত্র ছিল জাল এবং দ্বিতীয় অভিযোগ ছিল সম্পত্তি বিভাজন কালীশংকরের ক্ষমতার আওতাভুক্ত ছিল না। ১৮৪৭ সালের ৫ অক্টোবর কোর্ট মামলা রুজু করে। এই মামলার তদন্ত একটু কঠিন ছিল।

কারণ এ তদন্তে কালীশংকর এবং তার ছেলের পুরা সম্পত্তি তাদের কর্ম এবং সম্পদের প্রকৃতি নিয়ে বিশদ পর্যালোচনা করতে হবে। কালিশংকরের সব কর্মযজ্ঞ এবং সম্পদের মধ্যে একটা গোমর ছিল। নিম্ন আদালতে গুরুদাসের অভিযোগ আমলে নেয়া হল। এ সময়ের মধ্যে উইল অনুযায়ী দুই পরিবার যার যার সম্পত্তি নিয়ে আলাদা আলাদা বসবাস করছিলো। বড় পরিবারটিতে যখন কালীশংকর মারা গেল তখন রামরতন পরিবারের প্রধান হলেন। তিনি সামর্থ্য দিয়ে জমিদারি বাড়াতে লাগল। এ সময়ের মধ্যে সে মোহাম্মদশাহী জয় করল যা তার জমিদারির সবচেয়ে বড় অংশ ছিল। রামরতনের ব্যবস্থাপনায় মুহাম্মদশাহী এবং পরিবারের স্টেট বৃদ্ধি পেতে থাকল। রামরতন ১৮৫৯ কিংবা ১৮৬০ সালে মারা যায়। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে হারনাথ পরিবারের প্রধান হন কিন্তু তিনি পরিবারের জন্য কিছু অর্জন করতে পারেননি। ১৮৬৮ সালে হারনাথ মারা গেলে রাধানাথ রায় পরিবারের প্রধান হন। তাদের দুজনের অর্জন রামরতন যা রেখে গেছেন সেই পরিমাণই রয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যগণ যশোর, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জে তাদের এস্টেট বৃদ্ধি করে। তাদের বেনারস এবং মির্জাপুরেও সম্পদ ছিল। তার পরিবার বসবাস করত নড়াইলে এবং কলকাতার কাশিপুর ও নড়াইল উভয় স্থানেই তাদের বিশদাকারে ব্যবসা ছিল। যশোর, ফরিদপুর এবং পাবনা এস্টেটে তাদের নীল চাষের ফ্যাক্টরি ছিল। ছোট পরিবারে গু্রুদাসের তেমন সম্পদ ছিল না এবং তার পরিবারের বিস্তৃতিও ছিল কম। যশোরের খালিয়ায় এবং ফরিদপুরের রুপাহাটায় তাদের প্রধান সম্পত্তি ছিল। তিনি তার সম্পত্তিতে অতিরিক্ত কিছু যোগ করতে পারেন নি, তার পরিবার নড়াইলে এবং রুপাহাটে বসবাসের স্থান ছিল। নড়াইলের পরিবার যখন ধর্ম চর্চা এবং উদারতায় নিয়োজিত ছিল না হিন্দুধর্মে যা বলা আছে। মদনগোপালের সময় থেকে এ পর্যন্ত নড়াইলের এবং অন্যান্য স্থানে প্রতীমা বসানো হয়েছে। তারা বিভিন্ন স্থানে কুয়াও খনন করেছে। তাদের ভাল কাজের মধ্যে একটা ছিল কলকাতা এবং মির্জাপুরে বড় গোসল করার ঘাট নির্মাণ। কালিশংকর বেনারসে গিয়ে ধর্মের কাজে কিছু টাকা ব্যয় করেছিলেন। তার ধর্মীয় কাজের মধ্যে প্রধান হল মির্জাপুরে বিশাল আকারে ‘ভূসি’ নামক ধর্মীয় অট্টালিকা নির্মাণ। বড় পরিবারের উত্তরাধিকারগণ বড় বড় জমিদারিতে তাদের অংশ দাবী করা শুরু করল। হারনাথ রায় যশোর এবং নড়াইলের মধ্যে সংযোগ রাস্তা তৈরি করতে প্রচুর অর্থ খরচ করেছেন। তার এই উন্নয়নমূলক কাজ এবং উদারতার জন্য সরকার তাকে ‘‘রায় বাহাদুর’’ পদে ভূষিত করল। শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। নড়াইলে একটা সবলতাকামী স্কুল তার তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হত। অবশেষে তারা নড়াইলে একটা ওষুধের দোকান স্থাপন করেন। এর সুপারিনটেডেন্ট ছিলেন ডাঃ এন্ডারসন। এই প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় খরচ নড়াইলের বাবুরা বহন করত। নড়াইল বাবুদের মধ্যে উলে­খযোগ্য ছিলেন রাধাচরণ, চন্দ্র কুমার, কালী প্রসন্ন, রামরতনের ছেলে, উমেষ চন্দ্রের ছেলে এবং রায় হারনাথ রায় বাহাদুরের নাতি কালীদাস ছোট পরিবারের গুরম্নদাসের সাথে অন্য পরিবারের সদস্যদের মিল ছিল না। তিনি কোন ভাল কাজের জন্য এগিয়ে আসতেন না এবং ভাল কাজ দেখলে নিরুৎসাহীত করতেন।