যশোরের রাজাদের ইতিহাস
বিশেষত চাঁচড়া রাজার পারিবারিক ইতিহাস, ১৫৯০ খ্রিঃ
বাংলার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ১৫৮০ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ বিদ্রোহ হয়েছিলো। এই বিদ্রোহ দমনের জন্য রাজা টোডরমল ও পরবর্তীতে আজিম খানকে সম্রাট আকবর বাংলায় প্রেরণ করেছিলেন। আজিম খান ১৫৮২ সালে আগমন করেন এবং ১৫৮৩ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ভবেশ্বর রায় নামক এক বীর যোদ্ধা আজিম খানের সেনাবাহিনীতে ছিলেন। যিনি এই বাংলায় আজিম খানের সাথেই এসেছিলেন। এই অঞ্চলে বসবাসের অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে আজিম খান ভবেশ্বর রায়কে রাজা প্রতাপাদিত্যের কাছ থেকে দখল করে নেয়া সৈয়দপুর, আমিদপুর, মুরাগাছা এবং মলিকপুর স্টেটসমূহ প্রদান করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায় বীর যোদ্ধা ভবেশ্বর রায় ১৫৮৮ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই সম্পত্তি ভোগ দখল করেছিলেন।
তার উত্তরাধিকার ছিলেন মুতাবরাম রায়। তিনি বাংলা ৯৫৫-১০২৫ (১৫৮৮-১৬১৯ খ্রিঃ) সাল পর্যন্ত মানসিংহের সাথে প্রতাপাদিত্যের চলমান যুদ্ধে মানসিংহকে সমর্থন দিয়েছিলন এবং বিজয়ী পক্ষির হয়ে কাজ করেছিলেন। তার এই কাজের কারণে তিনি তার প্রাপ্ত ৪টি পরগনার উপরই দখল বজায় রাখতে পেরেছিলেন। তার মেয়াদের শেষ ৪ বছরের নথি থেকে জানা যায় তার দখলী জমির জন্য যে খাজনা আদায় করা হতো তা তার আগে কেউ কখনও করেনি।
মুতাবরাম রায়ের পরবর্তী উত্তরাধিকারী হলেন কন্দর্প রায় যিনি বাংলা ১০২৬ -১০৫৬ (১৬১৯ থেকে ১৬৪৯) সাল পর্যন্ত এই পরগনাসমূহের দখলে ছিলেন। এছাড়াও তিনি দায়িত্ব, খালিশখালি, বাঘমারা, সেলিমাবাদ, সাজিয়ালহর ও সৈয়দপুরের দক্ষিণ পশ্চিম পর্যন্ত তার জমিদারিকে বৃদ্ধি করতে পেরেছিলেন।
মনোহর রায় তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে নবাবদের নিকট হতে স্টেটের সমস্ত কর্তৃত্ব লাভ করেন। তিনি নবাবদের খাজনা প্রদান করতেন। তার অধীনে ক্ষুদ্র স্টেটগুলোর বকেয়া অনেকদিন যাবত অপরিশোধিত ছিল যা তিনি একাই পরিশোধ করে তার জমিদারি অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। তাই আমরা দেখতে পাই যে তার জমিদারির সময় নিম্নলিখিত পরগনাগুলা তার অধীনে ছিলঃ
১। রামচন্দ্রপুর - ১৬৮২
২। হাছেনপুর - ১৬৮৯
৩। রংদিয়া এবং রহিমাবাদ - ১৬৯১
৪। চিংগুটিয়া - ১৬৯১
৫। ইসাফপুর - ১৬৯৬
৬। মালয়, সোবনল, সোবনা - ১৬৯৯
৭। সাহস - ১৭০৩
এছাড়া তিনি কিছু ছোট ছোট পরগনাও অধিগ্রহণ করেছিলেন যেমন টাল্লা, পালুস, ভাটলা ও ক্যালকাটা। মনোহর রায়কে মনে করা হয় এই পরিবারের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। যখন তিনি এই জমিদারিটি অর্জন করেছিলেন এটি ছিল একটি মধ্যম মানের জমিদারি। কিন্তু যখন তিনি এটা ছেড়ে গেলেন তখন এটা হলো তার প্রতিবেশীদের তুলনায় সর্ববৃহৎ জমিদারি। প্রাপ্ত তালিকা এবং তার অধিগ্রহণের প্রকৃতি বলে দেয় যে তৎকালীন সময়ে বেশীরভাগ পরগনাই ছিল তার জমিদারির অধীন। মিলিটারী সার্ভিসের নামে তার পূর্বপুরুষেরা যেভাবে জমি দখল করেছিলো তিনিও সেভাবে জমি দখল করেছিলেন বিধায় এত জমির মালিক তিনি হতে পেরেছিলেন। ইসাফপুরের জমিদার কালিদাস রায় তার মতই বড় জমিদার ছিলেন। এছাড়াও এমন কিছু পরগনা ছিল যা বড় কোন স্টেটের অংশ ছিল না, যেমন হোগলা ও সুলতানপুর। এই পরগনাগুলো বিভিন্ন পরিবারের অধীনে ছিল। সুতরাং দেখা যায় যশোরের রাজার স্টেট এই সকল প্রতিবেশী পরগনাসমূহের অধিগ্রহণের উপর প্রতিষ্ঠিত হলো।
এখানে একটু বলে নেয়া ভালো যে, ‘রাজা’ শব্দটির আসলে কোন নির্দিষ্ট অর্থ ছিল না। এটা দিয়ে বংশীয় কোন আভিজাত্যকেও বুঝাতো না। তখনকার সময় প্রতিটি বড় জমিদারই ‘রাজা’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন এবং দাপ্তরিক চিঠিপত্রে তৎকালীন কর্তৃপক্ষ নলডাংগা, যশোর ও নাটোরের রাজাদের মাঝে মাঝে ‘রাজা’ বলে সম্বোধন করতেন আবার করতেন না। মনোহর রায় বাংলা ১১২২ (১৭০৫ খ্রিঃ) সালে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার ছেলে কৃষ্ণরাম ১৭২৯ খ্রিঃ পর্যন্ত জমিদারি করেন। তার আমলে মহেশ্বরপাশা পরগণাটি জমিদারির অন্তর্ভুক্ত হয়। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণনগরের নিকট হতে বাজিতপুরের কিছু অংশ তিনি ক্রয় করেছিলেন।
তারপর রাজা হন সুখদেব রায় এবং মনোহরের বিধবা স্ত্রী তার ছেলে শ্যামসুন্দরের নামে পুরো স্টেটের ৪ আনা সম্পত্তি লিখিত করে নেন। যার ফলে স্টেট প্রথমবারের মত দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পরবর্তীতে সুখদেবের ১২ আনা সম্পত্তি নিয়ে তার পুত্র নীলকান্ত ১১৫২ (১৭৪৫ খ্রিঃ) সালে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। ইত্যবসরে শ্যামসুন্দর ও তার শিশু পুত্রের দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর কারনে তাদের প্রাপ্ত বাকি ৪ আনা সম্পত্তি ১১৬৩-১১৬৪ (১৭৫৬-১৭৫৮ খ্রিঃ) সাল পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে কর্তৃত্ববিহীন অবস্থায় চলে যায়।
ঐ সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবদের কাছ থেকে কলিকাতার সন্নিকটে জমির অনুদান পান এবং সালাউদ্দিন খান নামক একজন জমিদারের জমি থেকে ইংরেজদের এই বরাদ্দ প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে সালাউদ্দিন খান জানতে পারেন যে শ্যামসুন্দরের ৪ আনা সম্পত্তির কোন উত্তরাধিকারী নেই। তাই তার পূর্ববর্তী সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ বাবদ ঐ জমির মালিকানা দাবী করেন। এই প্রেক্ষিতে নবাব শ্যামসুন্দরের চার আনা সম্পত্তি সালাউদ্দিন খানকে দান করে দেন। যদি শ্যামসুন্দর মৃত না হত তাহলে যশোরের এই সম্পত্তি কোনদিনই ভাগ হত না এবং বাইরের কেউই এই সম্পত্তিতে ঢুকতে পারত না। ঐ চার আনা শেয়ারের সম্পত্তির বেশিরভাগই ছিল সৈয়দপুর পরগনার মধ্যে যা এখন সৈয়দপুর স্টেট নামে পরিচিত। আর বাকি ১০ আনা নিয়ে ছিল ইসাফপুর স্টেট। ইসাফপুর ছিল প্রধানতম পরগনা। রাজা শ্রীকান্ত ১৮০২ সালে মারা যান এবং তার পুত্র বনিকান্ত পরিবারের প্রধান হন। তিনি তখন সরকারের পেনশনভুক্ত ছিলেন। ১৮০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে তিনি আবার জমিদার হন এবং অবসরকালীন ভাতা ত্যাগ করেন।
বনিকান্ত মারা যাওয়ার সময় তার ছেলে বরদাকামন্ত ছিল নাবালক। তিনি ১৮১৭ সালে উত্তরাধিকারী হন। বরদাকামন্ত নাবালক থাকা অবস্থায় ‘কোর্ট অব ওয়ার্ড’ আইনের বলে স্টেটের হিসাব নিকাশ করা হত। সাহস পরগনা যা ঐ পরিবারের সবচেয়ে প্রাচীন সম্পত্তি তা সরকারের মাধ্যমে পুনঃস্থাপন করা হয়। ঐ দু’টি পরগনা ছাড়াও আরো ছোট ছোট পরগনা ছিল। তৎকালীন বর্ধমানের প্রতিনিধি রাজা বরদাকামন্ত সিপাহী বিদ্রোহের সময় তার বিশেষ অবদানের জন্য সরকারের কাছ থেকে ‘রাজা বাহাদুর’ সনদ প্রাপ্ত হন। তার পরিবারের অবস্থান যশোরের খুব নিকটবর্তী ছিল। কিন্তু তিনি শেষভাগে যশোর থেকে দূরে বসবাস করতেন। ইসাফপুর স্টেটের ১৬ আনা সম্পত্তির ৪ আনা সম্পত্তি সালাউদ্দিন খানের অধীনে ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় ঐ সম্পত্তি একজন মুসলমান মহিলার অধীনে ছিল যার নাম ছিল মুন্নুজান। তিনি ছিলেন সালাউদ্দিনের বিধবা পত্নী এবং একজন ভালো ব্যবস্থাপক। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জটিল সময়েও ঐ সম্পত্তি তিনি নিরাপদে রেখেছিলেন। ১৮১৪ সালে মুন্নুজানের সম্পত্তি তার সৎ ভাই হাজী মোঃ মহসীনের কাছে চলে আসে এবং ঐ বছরই মহসীন মারা যান। তার কোন উত্তরাধিকারী না থাকায় তিনি স্টেটটি হুগলীর ইমামবাড়ার উন্নয়নের জন্য একটি ট্রাস্ট গঠন করেন যা সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত রাজস্ব বৃদ্ধি করে আসছে। এই স্টেটের ক্ষুদ্র অংশ যার নাম ছিল তারাফ সোবনল যা এই ইমামবাড়ার নামে চিরস্থায়ীভাবে বন্দোবস্তকৃত ছিল। এই স্টেটটি সৈয়দপুর স্টেট নামে পরিচিত। এটাই ছিল শ্যামসুন্দরের সেই চার আনার সম্পত্তির চূড়ান্ত ফলাফল।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস