ভূমি রাজস্ব প্রশাসনের ইতিহাস
১৭৬৫ সালে বাংলার দেওয়ানী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে অর্পণ করা হয়। ইউরোপীয় কর্মকর্তাদের ভূমি বিষয়ক তেমন ধারণা ছিল না বলে ভূমি প্রশাসন তাদের কাছে জটিল মনে হত। ১৭৬৯ সালে মি. ভেরলস্ট ইউরোপের কিছু কর্মকর্তাকে রাজস্ব আদায়ের জন্য নিয়োগ করল। দেশের বিভিন্ন অংশে ভূমি প্রশাসনে দেশের কর্মকর্তাদের স্থলে তাদের বসানো হল। ১৭৭০ সালে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে একটা কাউন্সিল গঠন করা হল যার সদর দপ্তর ছিল মুর্শিদাবাদ ও পাটনাতে। জমির আবাদ ক্ষমতা এবং এর প্রকৃতি সম্পর্কে একটা বিশদ বিবরণ দেয়ার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয়া হল। কৃষকদের কাছ থেকেও তাদের চাহিদাপত্র চেয়ে নেয়া হয়েছিল এবং এই সংক্রান্ত রিপোর্ট বিচার বিভাগের নিকট জমা প্রদানের নির্দেশ দেয়া হল। রিপোর্টে প্রকাশ পেল যে, অভ্যন্তরীণ সরকার বিশৃংখল অবস্থায় আছে এবং লোকজন চরমভাবে শোষন-নিপীড়ন ভোগ করছে। ভূমি প্রশাসন দেওয়ানীর কাছ থেকে গ্রহণের সাত বছর পরেও কোম্পানী এই সমস্ত অব্যবস্থাপনা দূর করতে পারেনি। কোলকাতায় একটা রাজস্ব বোর্ড স্থাপন করা হয়েছিল। কর্মকর্তাদের কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিজন কালেক্টরের সাথে একজন করে দেশীয় দেওয়ানও নিয়োগ দেয়া হল। ইউরোপের কর্মকর্তাদের ১৭৭৪ সালে পুনরায় ভূমি প্রশাসন থেকে তুলে নিয়ে দেশের এজেন্টদের চাকুরীতে পুনর্বহাল করা হল। ১৭৮৬ সালের মধ্যে আবার ইউরোপের অফিসারদের কালেক্টর পদে স্থলাভিষিক্ত করা হল। সর্বপ্রথম যশোরে মিঃ হেঙ্কেল কে কালেক্টর, সিভিল জজ এবং ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে নিয়োগ দেয়া হয়।
বাংলার অন্যান্য জেলার মত যশোরে ১৭৭২ সালে জমি বন্দোবস্ত করা হয়। মি. লেন নামে এক কর্মকর্তার তদন্তের সাপেক্ষে এ বন্দোবস্ত করা হয়। জমিদারদের স্টেটের উপর প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মিঃ লেনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এরপর আর কোন তদন্ত করানো হয় নি। কালেক্টরের প্রতিবছরের বন্দোবস্তের আলোকে তিনি কিছু নীতি নির্ধারণ করলেন। তারপর তিনি একটা খসড়া হিসাব করলেন। তার মতে বন্ধুত্বপূর্ণ নিষ্পত্তি না হলে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করা হবে। বাকি পত্তনের ক্ষেত্রেও একই ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যে জমিদাররা ডিফল্টার তাদের জেলে পাঠানো হয়। নামপত্তনের জন্য স্টেটগুলো বিক্রি করা একটা সুবিধাজনক কৌশল ছিল। একটা বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ মুঘল আমলের ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা ভাবল। সুলতানপুরের জমিদার কর না দেয়ার জন্য ডিফল্টার হল, তখন তার স্টেট কাশীনাথের কাছে এই শর্তে হস্তান্তর করা হল যে সে নামপত্তন করে নিবে এবং ভবিষ্যতে রাজস্ব প্রদান করবে। ত্রুটিপূর্ণ ডাটার কারণে বার্ষিক রাজস্ব নির্ধারণে ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছিল। জমিদারদের উপর করের একটা বড় বোঝা সৃষ্টি হলো। অনেকে ঋণি হয়ে পড়লেন। মি. হেঙ্কেল তখন রিপোর্ট করলেন যে, জমিদাররা যে ট্যাক্স দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি আদায় করা সম্ভব হবে না। মিঃ রকি হিসাব করে দেখলেন ১৭৭২ সালের বন্দোবস্তের পর রাজস্ব আদায়ে তেমন উন্নতি হয় নি। জমিদাররা কর পরিশোধ করার জন্য প্রজাদের উপর চাপ দিত। আবার জমিদারদের স্টেট কমে যাওয়ায় চাষাবাদ ১৭৭২ সালের চেয়ে ১৭৯০ সালে অনেক কম হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে স্যার জেমস ওয়েস্টল্যান্ড বলেন- ‘‘জমিদাররা হতাশ হয়ে পড়ল। তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। তাই তারা চাচ্ছিল প্রজাদের কাছ থেকে যত সুবিধা নেয়া যায় ততই ভাল। প্রজারা জমি চাষাবাদে যাচ্ছে না কারণ তারা জানত সকল সুবিধা জমিদাররা নিয়ে যাবে। কালেক্টরের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে জমিদাররা তাদের স্টেটের কোন ধরণের উন্নতি করতে পারে নি। কালেক্টর, জমিদার এবং প্রজাদের মধ্যে এই অসন্তোষ বার্ষিক বন্দোবস্তে বাধা সৃষ্টি করে এবং উন্নতির পথ রুদ্ধ করে দেয়’’।
ভূমি প্রশাসন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে যে ফল পাওয়া গিয়েছিল তার ভিত্তিতে একটা কেস স্টাডি হল যেখানে- মুহাম্মদ শাহী জমিদারী নিয়ে একটা উপস্থাপনা আছে। ১৯৭২ সালে এই স্টেটের নামপত্তন হয়। মি. লেন ঐ স্টেটের উপর তদন্ত করেন। স্টেটটি দুইটি ভাগে বিভক্ত ছিল- চার-পঞ্চমাংশ এবং এক-পঞ্চমাংশ, চার-পঞ্চমাংশের উদ্যোক্তা স্টেটের নামপত্তন করতে ব্যর্থ হলে প্রাণ বোসের ফার্মে হস্তান্তর করা হয়। তিনি ১৭৭৯ বা ১৭৮৪ সালে নিজের বা ছেলের নামে নামপত্তন করে নেন। প্রাণ বোস চাচ্ছিলেন তিনি স্টেটের একটা অংশের কর দিবেন। সরকার নির্ধারিত কর দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। প্রজাদের অতিরিক্ত টাকা দিতে জমিদার বাধ্য করত। তাই অনেক প্রজা জমি চাষাবাদ বাড়িয়ে দিল, আবার কেউ কেউ পালিয়ে গেল। তালুকদারদের কাছেও অতিরিক্ত কর দাবী করা হল। তাদের মধ্যে অনেককে তালুকদারী থেকে সরিয়ে দেয়া হল। কর দেয়ার ভয়ে আবার অনেকে পালিয়ে গেল। ফলশ্রুতিতে অনেক জমি অনাবাদী পড়ে রইল।
সরকার তখন জমিদারের ক্ষতির একটা ভাগ নিল এবং কম পরিমাণে কর ধার্য করল। ১৭৭২ সালে যেখানে কর ধার্য করা হয়েছিল ২,৮৭,৬১৪ রুপি। ১৭৮৫ সালে ধার্য করা হল ২,৪৪,২২৩ রুপি। এমনকি এই হ্রাসকৃত করও তাদের কাছে এতো বেশি মনে হল যে তারা দুই বছর পর নামপত্তন হারাল। ১৭৮৭ সালে তাকে উচ্ছেদ করা হল এবং পুরা স্টেটটি কয়েকভাগে বিভক্ত করা হল। প্রতিটি অংশের জন্য কর্ম কর ঠিক করা হল। এমনকি সেই করও আদায় হয়নি এবং জমিদারদের দোষী সাব্যস্ত করে স্টেট থেকে বিতাড়িত করা হল। ১৭৯৩ সালে সরকার দশ বার্ষিক জমি বন্দোবস্তের ঘোষণা দেন এবং মি. হেঙ্কেলকে সফলকামী করেন। এই বন্দোবস্ত পুরাতন বন্দোবস্তের চেয়ে অনেক অগ্রগামী ছিল। প্রতিটি নাম পত্তনে সম্পদের সঠিক পরিমাণ করা হয়। জমিদারেরা করমুক্ত জমিগুলো ধরে রাখেন এবং সরকার তাদের হাতে তা তুলে দেন। তখন একটা স্থায়ী করারোপ নীতি চালু করা হল। জমিদাররা প্রজাদের নিয়ে নতুন করে চাষাবাদের দিকে মনোনিবেশ করেন। প্রজারা আগ্রহের সাথে কাজ শুরু করলো কারণ প্রজারা নিজেদের বাসার কর নিজেরাই পরিশোধ করতেন। পূর্বে প্রজারা জমিদারদের কত খাজনা দিবেন তা নির্ধারিত ছিল না।কালেক্টর এবার করের পরিমান নির্ধারণ করে দিলেন-জমিদার সরকারকে কী পরিমাণ খাজনা দিবে এবং প্রজারা জমিদারদের কী পরিমাণ খাজনা দিবে। আরেকটা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় জমিদারদের উপর নির্ভরশীল তালুকদারদের। তালুকদাররা তাদের খাজনা জমিদারের মাধ্যমে পরিশোধ করত। দুই ধরণের তালুক ছিল। পত্তন তালুক ও খরিদা তালুক। পত্তন এবং খরিদা তালুকদার মূলত জমিদারদের মাধ্যমেই পরিচালিত হত। স্টেটের ছোট কোন অংশে তারা বসবাস করত এবং বছরে কিছু খাজনা দিত। সরকার পরে সিদ্ধান্ত দিল তালুকদাররা খাজনা জমিদারদের কাছে না দিয়ে সরাসরি সরকারের কাছে দিবে। অন্য আর একটা পরিবর্তন আনা হল হাট-বাজারের উপর কর ধার্য করে। এ সমস্ত অবস্থার প্রেক্ষেতে কালেক্টরের হিসাব-নিকাশ সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। কিন্তু বড় স্টেটগুলোর বিষয়ে বোর্ড প্রাক্কলন তৈরী করেছিল। বড় স্টেটগুলোর খাজনার ব্যাপারে নেয়া সিদ্ধান্ত গুলো জমিদাররা মেনে নিতে পারেননি। জমিদাররা শর্তগুলো নিয়ে সরকারের সাথে অনেক তর্ক-বিতর্ক করেছিলেন কিন্তু অবশেষে সরকারের নেয়া সিদ্ধান্তই মেনে নেন। অবশেষে বেশিরভাগ জমিদার পরিবার তাদের এস্টেট হারাল। এর পরিমাণ নির্ধারণ করা কঠিন ছিল কারণ তখন প্রজারা ছিল ক্ষমতাবান। যদি কোন প্রজা খাজনা দিতে ব্যর্থ হত তাদের বিরুদ্ধে কোর্টে মামলা করা হত। এ সময়ের মধ্যে প্রজারা অনেক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে নিত। কালেক্টর বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করা একটা জটিল এবং কঠিন কাজ। ১৭৯৯ সালের ২১ জানুয়ারি কালেক্টর তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জানালেন যে, প্রজারা ঠিকমত খাজনা পরিশোধ করে না এবং তার আদেশ মানে না। প্রজাদের বিরুদ্ধে মামলা করে ভাল কোন ফল না পেয়ে কালেক্টর কর্তৃপক্ষের কাছে জেল প্রদানের ক্ষমতা চাইলেন। প্রজাদের একগুয়েমির কারণে পুরাতন জমিদারি প্রথা ভেঙ্গে পড়ল। তাই স্থায়ী বন্দোবস্তের পূর্বেই অনেক জমিদার কর না দেয়ার কারণে তাদের জমি হারান।
কালেক্টরদের কাছ থেকে প্রতিবেদন নেয়া হয়েছিল। ১৮০০ সালে কালেক্টর প্রতিবেদন দিলেন যে, কমপক্ষে ১০০০ টি স্টেটের কর বকেয়া আছে। যে সমস্ত জমিদার জমিদারী হারিয়েছে তারা সবাই বড় মাপের ভূস্বামী ছিলেন। ইউসুফপুরের রাজা শ্রীকান্ত রায় একের পর এক তার স্টেট হারিয়েছেন। স্থায়ী বন্দোবস্তের ১০ বছরের মধ্যে নলডাঙ্গা পরিবার তাদের সম্পত্তি হারালো। সমস্ত জমিদারের মধ্যে মাত্র দুইটি জমিদারি টিকে ছিল- একটা হল সৈয়দপুর ট্রাস্ট এবং অন্যটা হল সুলতানপুর ট্রাস্ট স্টেট। দুর্বিষহ এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সরকারকে এ বিষয়ে নিয়ে পর্যালোচনা করতে হয়েছিলো। এরপর সমাধান হিসেবে ১৭৯৯ সালের ৭নং রেগুলেশন গ্রহণ করা হল। এর ফলে পূর্বের জমিদারদের স্টেট ফেরত দেয়া সম্ভব হয়নি; কিন্তু যারা নতুন স্টেট ক্রয় করেছে তাদের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা হল। ঋণের কারণে জমিদাররা তাদের স্টেটের জন্য ভাল কিছু করতে পারছিলেন না। যারা নতুন করে বড় বড় স্টেটগুলো কিনে নিয়েছিল তাদের বেশিরভাগই কলকাতায় ব্যবসা করত। রাধামোহন ব্যানার্জী মুহাম্মদশাহী কিনে নিয়েছিলেন। ১৮০১ সালের মধ্যে তার মেধা এবং কাজের প্রতি একাগ্রতার জন্য তাকে ‘বেস্ট ম্যানেজার’ বলা হত। তিনি প্রজাদের সাথে ভাল ব্যবহার করতেন। ১৮০২ সালে কালেক্টর জমি চাষাবাদের উপর জোর দেন। ১৮১১ সালে তিনি পতিত জমি পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করে চাষাবাদের উপযোগী করে তোলেন। এ জেলার রাজস্ব খাতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল খাজনা বিহীন ভূমিতে খাজনা আরোপ করা। ১৭৭২ সালের পূর্বে জমিদারা অনেক জমি খাজনা না দিয়ে ভোগ করত। জেলার প্রায় এক লক্ষ ষোল হাজার একর জমির খাজনামুক্ত ছিল। সরকার খাজনা দেওয়ার কথা বললেও তখন জমিদারদের খাজনা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। কালেক্টর হস্তান্তরকৃত জমি উদ্ধার করার চেষ্টা করলেন কিন্তু কাগজ-পত্র প্রস্তুত ছিল না বলে ব্যর্থ হলেন। স্থায়ী বন্দোবস্তের সময় সরকার নিখুঁতভাবে খাজনামুক্ত সরকারী অনুদান আলাদা করতে চেষ্টা করলেন। সরকারী অনুদান আবার দুই ধরণের- বাদশাহী আর হুকুমী। বাদশাহী অনুদান শাসকেরা দিয়েছেন এবং হুকুমী অনুদান তার অধীনস্থ কর্মচারীরা দিয়েছে। ১৭৯৩ সালের XXXVIIনং প্রবিধানে বাদশাহী অনুদানের কথা বলা আছে এবং XIXনং প্রবিধানে অন্যান্য অনুদানের কথা উল্লেখ আছে। বাদশাহী অনুদানকৃত জমিগুলো বৈধ ছিল যদি তা বংশানুক্রমিকভাবে চলতে থাকে। হুকুমী অনুদান ছিল অবৈধ। তবে ১৭৬৫ সালের পূর্বেই তা বৈধ করে দেয়া হয়। প্রবিধান XIXএর আলোকে জমিদার কর্তৃক খাজনা মুক্ত অনুদানগুলো ১৭৯০ সালে অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
এই সমস্ত প্রবিধান সংশোধনের বাস্তবসম্মত প্রয়াস বোর্ড গ্রহণ করে নি। তবে ১৮০০ সালে লাখেরাজ অনুদানের জন্য রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এ ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে প্রবিধান এর আলোকে ১৮১৯ সালে এর ক্ষমতা সিভিল কোর্ট থেকে রাজস্ব কোর্টে চলে যায়, ১৮২৮ সালে প্রবিধান ওওও এর শর্তমতে একজন নির্বাহী পরিচালক নিয়োগ করা হয় যিনি সরকারের বাসত্মবসম্মত নীতি নিয়ে কাজ করেন। তার তত্ত্বাবধানে ১৮৩০ থেকে ১৯৫০ সালের মধ্যে অনেক স্টেট খাজনা প্রদানের অমত্মর্ভুক্ত হল। ঐ স্টেটগুলোর মালিকদের জমিদার অথবা তালুকদার বলা হত। অন্যান্যদের ভূস্বামী নামে ডাকা হত। স্টেটগুলোকে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হয়। এগুলো সরকারকে টাকা দিয়ে কিনতে পারলে বিভিন্ন অংশের মালিক হওয়া যেত। প্রতিটি অংশ কে তালুক বলা হয়। এর মালিকরা জমিদারদের মত সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে লাগলেন। এর ফলে স্টেটগুলো স্বাধীন হতে লাগল। জেলায় ১,১৭৬ টি ঘর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এবং এই বসতবাড়িগুলোর খাজনা আদায় হত মুঘল নিয়মের আওতায়। গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী দ্বারা এগুলো বিভাজিত ছিল। আরাকানের রাজা জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্যই মুঘল নিয়মে খাজনা আদায় হত। প্রতিটি বড় বড় স্টেটের বিভাজিত অংশগুলো আলাদা আলাদাভাবে বিক্রি করা হল এবং যারা ক্রয় করেছেন তারা প্রত্যেকে খরিদা তালুক এর মালিক হলেন।
স্থায়ী বন্দোবসেত্মর সময় সরকারের অধীনে জেলায় মাত্র ১২২টি স্টেট ছিল। দশ বছরের মধ্যে প্রায় সবগুলো স্টেটই নামপত্তনের আওতায় পড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ ১৭৯৩ সালে ইউসুফপুর পরগনা রাজা শ্রীকান্তের অধীনে ছিল যা তিন বছরের মধ্যে ১টি বড় এবং ৩৯টি ছোট স্টেটে ভাগ করে বিভিন্ন প্রোপাইটরের নিকট বিক্রি করা হয়। ১৮০২ সালে মুহাম্মদ শাহী ১১৫টি স্টেটে এবং ভূষণা ৬৬টি আলাদা আলাদা স্টেটে বিভক্ত হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে যশোরের ১২২টি স্টেট বিভাজিত হয়ে ৫,০৪৪ টি ছোট জমিদারিতে রূপান্তরিত হয়। যশোরের আয়তন পুনঃসংশোধনের সময় এর আয়তন ছোট করে বিভিন্ন সময়ে জমিদারিগুলো অন্যান্য জেলায় হস্তান্তর করা হয়। ১৮৭৩ সালে যশোরে ৫৭০টি বড় এবং ২,২৮৬টি ছোট স্টেট ছিল। ১৮৮৩-৮৪ সালে ঐ সংখ্যা কমে দাঁড়াল ২,৫৮০টি। পরবর্তীতে কর প্রদানকারী স্টেটের সংখ্যা ২,৬৮৯টিতে এসে দাঁড়াল। বড় বড় স্টেটগুলোর প্রকৃতি নিয়ে স্যার জেমস ওয়স্টল্যান্ড তার ‘রিপোর্ট অন যশোর’ এ লিখেছেন- ‘‘স্থায়ী বন্দোবস্তের পর ছোট জমিদারি এবং ছোট জমিদাররা বড় জমিদারি ও বড় জমিদারদের স্থান দখল করেছেন। ছোট মাপের জমিদাররা বিভিন্নভাবে অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে বিভিন্ন জমিদারি ক্রয় করে বিশাল স্টেটের মালিক হয়েছেন। এই জমিদারিগুলো পুরাতন জমিদারির চেয়ে আলাদা কারণ জমিদারিগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন উপায়ে একত্র করে বড় স্টেটে রূপান্তর করা হয়েছে। এই জমিদারগণ খোলা-মেলাভাবে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করত এবং তারা অনেক সম্পত্তি ভোগ-দখল করত। ভোগ-দখলকৃত সম্পত্তিগুলো তারা অন্যদের ইজারা দিয়ে খাজনা আদায় করত। গাতী, জোত এবং পাটনী তালুক উল্লেখ করার মত। প্রথম দুইটি নিয়ে স্যার জেমস ওয়েস্টল্যান্ড বলেন- নিম্ন শ্রেণীর প্রজারা সাধারণ প্রজার ভূমি থেকে একটা লাভ নিতে চায়। প্রজারা নিজেদের ভূমি নিজেরা চাষ করে। কিন্তু কখনো ঐ জমির মালিকানা দাবী করেনি। যে জমি তার চাষ করত সেগুলোকে ‘জামো’ বলা হত। ঐ শ্রেণীর প্রজাদের বাইরে আর এক দল ছিল যারা নিজের জমি চাষ করত না। চাকর দিয়ে করাত। এই শ্রেণীর প্রজারা নড়াইল এবং মাগুরায় বসবাস করত এবং তাদের জোতদার বলা হয়। জেলার পশ্চিমাংশে যারা বসবাস করত তাদের ‘গাতীদার’ বলা হত। ‘জোতদার’গণ নলন্দীর বিভিন্ন স্থানে বসবাস করতে লাগল। তাদের বেশির ভাগ লোকজনই সাবলম্বী ছিল। তারা যে ধারণা করেছিল সে তুলনায় তাদের খাজনা কম হত।
স্যার জেমস ওয়েস্টল্যান্ডের মতে-জমি পুনরুদ্ধারের সময় ক্ষমতার দাপটে কিছু জমি জমিদাররা ভোগ-দখল করতে থাকে। ১৭৯৮ সালের ভুষণার উদাহরণ তিনি উল্লেখ করেন। প্রতিটি জোতের জমিগুলো এলোমেলো জড়িয়ে ছিলে, প্রতি জোতের জমিগুলা পুনরুদ্ধার শুরু হল এবং জোতদাররা তা পুনরুদ্ধার শুরু করল। আঠারো শতাব্দীর শেষে নলদী এবং তেহাটি জোত সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধার হয়েছিল। ভোগ-দখলের উৎসকে ‘গাথী’ বলা হোক বা না হোক কৃষকদের উপর স্বতন্ত্রভাবে খাজনা ধার্য করে জমি দেয়া হয়েছিল; যার ফলে গাথী এবং কৃষকদের মধ্যে একটা সম্পর্ক রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় এখনও গাথীদারদের কৃষক শ্রেণী বলে মনে করা হয়। গাথীদার এবং কৃষকদের মধ্যে একটা যোগাযোগ ছিল যা মিঃ হেঙ্কেল তার একটা চিঠিতে উল্লেখ করে গেছেন।
তিনি বলেন যে, প্রজারা তাদের খাজনা হয় গাতীদারদের কাছে দিত নতুবা কৃষকদের কাছে দিত। এটা তখনকার সময়ের রীতি ছিল, বর্তমানে ঐ পদ্ধতির অস্তিত্ব নেই। চাঁচড়ার রাজা ১৭৯৬ সালে যখন বিপদে পড়ল তখন তিনি ইউসুফপুর স্টেটটি উদ্ভাবন করলেন। বর্ধমানের মহারাজা কর্তৃক পাটনী তালুকের উৎপত্তি। স্থায়ী বন্দোবস্তের সময় স্টেটের জন্য খাজনা ধরা হল অনেক বেশি। খাজনা নির্ধারণের জন্য একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকার জমি মধ্যম আয়ের লোকদের কাছে দেয়া হল। এই সমস্ত ভোগ-দখলকৃত সম্পত্তিকে পাটনী তালুক বলে। সম্পত্তি দখলদারীত্বের বিষয়টি কিছু নিয়ম-কানুনের আওতায় আনা হয়েছিল। এটি জমিদারদের জন্যও প্রযোজ্য ছিল। ১৮১৯ সালের রেজুলেশন VIII এর পাটনী বিক্রির জন্য আইনের আলোকে ঐ সমস্ত ভোগ-দখলকৃত সম্পত্তি বিক্রি করা হয়। এটা করা হয়েছিল জমিদারদের খাজনা দেয়ার চাহিদার ভিত্তিতে। যশোরের প্রায় সব জায়গায় অনেক পাটনী ছিল। নলদীতে ১৮১৯ সালে মাত্র ৫টি পাটনী ছিল। স্থায়ী ইজারা প্রদানের পর এর সংখ্যা ২২১ থেকে ১,৮৫১ এ উন্নীত হল। পাটনীগুলো তখন জমিদারদের কাছে খুব জনপ্রিয় হলো।
বাংলায় প্রজাসত্ত্ব আইনের ৫০ ধারা মতে যশোরের ভূস্বামীরা যদি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হতেন যে, ২০ বছরের মধ্যে জমির খাজনা পরিবর্তন করা হয় নি, (অর্থাৎ এটা স্থায়ীভাবে নির্দিষ্ট করা) তাহলে প্রজাদের ভোগ-দখলকৃত বাড়িগুলো স্থায়ীভাবে বংশানুক্রমিকভাবে পুনঃবণ্টন করা হতো। ফলশ্রুতিতে যারা চাষাবাদের সাথে সম্পৃক্ত নন তাদের ভোগ-দখলের অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে জমিগুলো নিম্ন শ্রেণীর প্রজাদের নিকট বর্গা দেয়া হতো। এই সমস্ত দালালরা প্রজাদের নিকট থেকে অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে সত্যিকারের কৃষদের কাছ থেকে উচ্চ খাজনা আদায় করত। উৎপাদিত শস্যের ৫ ভাগের দুইভাগ দালালদের দিতে হত। নিম্ন শ্রেণীর প্রজারা নগদ টাকা না দিয়ে ফসল দিত। যদি ফসল দিত তবে উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক দিতে হতো। আর যদি ক্যাশ দিত তবে ভোগ-দখলকৃত প্রজার চেয়ে ২ গুণ বেশি দিতে হতো। যশোরে এক প্রকার ব্যতিক্রমধর্মী জমি-জমা ছিল যা ‘উঠলান্দি’ নামে পরিচিত ছিল। জমি চাষের সাথে এর সম্পর্ক। ১৮৮৪ সালে কালেক্টর এর বর্ণনা দিচ্ছেন এভাবে- ‘‘এ জেলায় কিছু ‘উঠলান্দি’ ধরণের ভোগ-দখলকৃত জমি ছিল। সেগুলো মূলত পতিত অনাবাদী জমি। বেশিরভাগ সময়ই জমিগুলো পানির নিচে থাকত এবং প্রজারা বিশেষ চুক্তিভিত্তিক চাষ করত। এই জমিগুলোর জন্য প্রজারা একটা নির্দিষ্ট খাজনা দিতে রাজি ছিল। ভূস্বামীরা খাজনার পরিণাম বাড়াতে পারত না। প্রজাদের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি ছিল তবে তারা এর মালিকানা দাবী করতে পারত না। প্রজাদের কোন ঝামেলায় পড়তে হত না কারণ তারা নিয়মিত খাজনা আদায় করত। জমিদারেরা প্রজাদের কাছ থেকে অকৃষি জমি থেকে খাজনা নিতেন না। প্রজারা জমিগুলো ধীরে ধীরে চাষ করা শুরু করল এবং ফলস উৎপাদনের পর খাজনা পরিমাপ করা হত। খাজনা নির্ধারিত হত তাদের সম্মতি নিয়ে।’’
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস