প্রাথমিক পুলিশ প্রশাসন (১৭৮১-৯০) ও অপরাধচিত্র
যশোর জেলার প্রথম জজ এবং ম্যাজিস্ট্রেট মি. টিলম্যান হেঙ্কেল পুলিশ প্রশাসনের সংস্কার করেন। ব্রিটিশ শাসনের সূচনালগ্নে ফৌজদারগণ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের অধীনে ছিল থানাদার। সর্বসাকুল্যে যশোর জেলায় সে সময় ৪টি থানা ছিল। এগুলো হল- ভুষণা, মির্জানগর, ধর্মপুর এবং নোয়াবাদ বর্তমান খুলনা। কিছুসংখ্যক Out Posts তথা চৌকি নিয়ে থানা গঠিত হত। থানার কর্মকর্তাগণ ছিলেন বেতনভুক্ত। কিন্তু চৌকিগুলো পরিচালিত হত গোয়েন্দা এবং তথ্য প্রদানকারীদের দ্বারা। এসব গোয়ন্দোরা বেতন পেতেন না। নিরীহ লোকদের কাছ থেকে আদায়কৃত অর্থের মাধ্যমে তারা জীবিকা নির্বাহ করত।
জনাব হেঙ্কেল মুড়লীতে এসেছিলেন ১৭৮১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি এবং তার কিছুদিন পরেই তিনি পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব প্রদান করেন। ফৌজদার ব্যবস্থা তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো জনগণকে তাদের অকথ্য অত্যাচার থেকে রক্ষা করে স্বতন্ত্র প্রদানের জন্য। বস্তুত পুরো ফৌজদার ব্যবস্থাই ছিলো অত্যাচার এবং দুর্নীতির দোসর। তৎকালীন সময়ে চারটি থানা ছিল যেমন-ভূষণা, মির্জানগর (ত্রিমোহিনীর কাছে অবস্থিত), নোয়াবাদ (খুলনায় অবস্থিত), এবং ধরমপুর। এরই মধ্যে এক জায়গায় শাহজিয়াল থানাটা ছিল। এই থানাগুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিলো অনেকগুলো চৌকি। থানায় বেতনভুক্ত কর্মকর্তা ছিল, কিন্তু চৌকিগুলো পরিচালিত হত গোয়েন্দা বা ইনফর্মাদের দ্বারা। এই গোয়েন্দা বা ইনফর্মাদের কোন বেতন ছিল না। যার কারণে এটা অবশ্যম্ভাবী ছিল যে তারা জীবিকার তাগিদে নির্দোষ লোকদের ধরে তাদের কাছ থেকে পয়সা হাতিয়ে নিবে। এটা এমন একটা পদ্ধতি ছিল যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা যেমন ফৌজদার ও থানাদার এই অপকর্ম বন্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। সম্ভবত তারাও এই অপকর্মের অংশীদার ছিলেন।
এই ফৌজদারী পুলিশ অপকর্মকারীদের প্রতিরোধ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। তবে তখনকার দিনে অনেক প্রজা জেলে ছিলেন। কিন্তু নির্দোষকে দোষীদের সাথে মেলামেশা থেকে খুব কমই সুরক্ষা প্রদান করা যেত। এ কথা একদম সন্দেহাতীতভাবে সত্য যে জনাব হেঙ্কেল যখন যশোর জেলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন জেলায় দস্যুদের প্রায় ৫০টি শক্তিশালী দল ছিল এবং তারা জেলার চারপাশে দস্যুতার জন্য ঘুরতো। ফৌজদার নিঃসন্দেহে ডাকাতি ও দস্যুতা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিয়েছিলো কিন্তু তা ছিল খুবই অপ্রতুল।
এরই প্রেক্ষেতে জনাব হেঙ্কেল মূলত জনবল পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছিলেন। পদ্ধতিগত কোন পরিবর্তনে কথা তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি বিলুপ্ত দুটি ফৌজদার কর্তৃপক্ষের অবস্থানে নিজেকে চিন্তা করে প্রস্তাব করেছিলেন যে, প্রতিটি থানায় গিরিদয়ার বা একজন পুলিশ প্রধান থাকবেন। তার দায়িত্ব হবে ডাকাত ধরা ও মুড়লী আদালতে নিয়ে এসে বিচারের সম্মুখিন করা। সেই পুলিশ প্রধানের অধীনস্থর ইনফর্মার হবে না। তারা হবে বিদেশী সিপাহী বা দেশী বরকন্দাজ যারা প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করতে সক্ষম। তার পুলিশী ব্যবস্থা ছিলো গোয়েন্দা মেজাজের থেকে অনেক বেশি মিলিটারি মেজাজের যা তৎকালীন অবস্থায় বেশি মানানসই ছিল। এই বাহিনীর লক্ষ্য ছিল শুধু ছোটখাট অপরাধের বিচার নয় বরং ডাকাতি ও দস্যুতার মতো বড় বড় অপরাধের নিয়ন্ত্রণ ও দমন। কোথাও যদি ডাকাতির ঘটনা ঘটতো তখন তদন্তটাই মুখ্য হতো। এক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের ডাকাত দলকে তাদের ঘাঁটি পর্যন্ত অনুসরণ করতে হতো। কিন্তু ডাকাত দলগুলো মূলত তাদের ঘাঁটির গোপনীয়তা রক্ষা করার চেয়ে তাদের দলের শক্তির উপর বেশি ভরসা করত এবং এটা ছিল একদমই একটা আধা সামরিক কার্যক্রম। যখন অনুসরণ শেষে গোয়েন্দারা ডাকতদের ঘাঁটির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতো, তখন সরকারি কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে জমিদারকে তার নিয়োজিত কর্মচারী (যে সবসময়ই একজন আধা পুলিশী চরিত্রের) বা লোকবল সরবরাহের জন্য বাধ্য করা হতো। কিন্তু হেঙ্কেলের প্রচলিত ব্যবস্থায় জমিদারদেও উপর থেকে এই নির্ভরশীলতা উঠে গেয়েছিল।
জমিদারি পুলিশ
জমিদারদের আলাদা পুলিশ বাহিনী রাখার কথা কোন আইনে বলা ছিল না। তাদের কাছে প্রত্যাশা ছিল যে তারা তাদের কর্মচারীদের মাধ্যমে তস্করদের নিকট হতে সম্পদ ও সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করবেন এবং দোষীদের কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করবেন। যখন জনাব হেঙ্কেল গিরিদার ও থানাদার নিয়োগ দিলেন, তাদের সাহায্যের জন্য জমিদারদের কর্মচারীদের আনা হত। তবে এক্ষেত্রে জমিদাররা বিরোধিতা করতেন। জনাব হেঙ্কেল তার একটি পত্রে অভিযোগ করেছিলেন যে ভূষণার জমিদারের নায়েব তার নিয়মিত পুলিশ বাহিনীকে তাদের পাইক বা নাকদিস (সশস্ত্র ফুটম্যান) প্রদানের মাধ্যমে সাহায্য প্রদানে বিরত থেকেছিলেন।
মুড়লীতে স্থাপিত নতুন থানা পূর্বতন পদ্ধতির কোন পুলিশ থানার মত ছিল না। এমনকি এর সাথে জনাব হেঙ্কেলের প্রস্তাবেরও কোন মিল ছিল না। জনাব হেঙ্কেল নিজেই সেই কাজটি করতে চেয়েছিলেন যা অন্যস্থানে থানাদারেরা করে থাকেন। যখন তার প্রস্তাবটি সরকার কর্তৃক গৃহীত হলো তখন ৫০ জনের একটি সিপাহীর দল মুড়লীতে পাঠানো হলো। এর পাশাপাশি ভূষণা ও মির্জানগরে ৩০ জন এবং ছোট থানা হিসেবে ধরমপুরে ৪ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। নোয়াবাদের(খুলনা) এইরূপ ফোর্স পেয়েছিলো বলে জানা যায় না। লবণ বিভাগের সাথে খুলনায় যে ফোর্স পাঠানো হয়েছিলো তাতে পূর্ণমাত্রায় সামরিক শক্তি ছিল বলে ধারণা করা হয়।
পুলিশের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে জমিদারদের নিকট হসত্মামত্মর (১৭৮২ খ্রিঃ)
এই নবসৃষ্ট পুলিশ পদ্ধতি প্রতি মাসে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা মাসিক বরাদ্দে চলত। কালক্রমে সরকারের বাণিজ্যিক চিমত্মায় এবিষয়টি অনেক ব্যয়বহুল বলে পরিগণিত হলো। জনাব হেঙ্কেলের অনুতাপ সত্ত্বেও সিপাহিদের পরিবর্তে বরকন্দাজেরাস্থলাভিষিক্ত হলো এবং এই আদেশ পালনের পূর্বেই সমগ্র পুলিশ ব্যবস্থা বিলুপ্ত হবে বলে সরকার ঘোষণা দিলো। শুধুমাত্র মুড়লীর পুলিশ বাহিনী জনাব হেঙ্কেলের সুবিধার্থে যথাস্থানে থেকে গেল।
যে সরকারি আদেশে এই পদক্ষেপ নেয়া হলো তাতে ঘোষণা করা হলো যে, সকল জমিদার, চৌধুরী ও তালুকদার যারা নিশ্চিতভাবে তাদের জমিদারি ও অন্যান্য ভূমির উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন, তাদের কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে যেন তাদের জেলায় কোন প্রকার দস্যুতা, চুরি, ও খুনের ঘটনা না ঘটে। সকল দোষীকে বিচারের আওতায় আনার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। যখনই ম্যাজিস্ট্রেট নির্দেশ করবেন তখনই তাদের থানায় যেতে হবে। তাদের যথেষ্ট পরিমানে কর্মকর্তা নিয়োগ করতে হবে এবং নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহিতামূলক আচরণ করতে হবে এবং একইসাথে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশের যথাযথ প্রতিপালন করতে হবে। যারা দস্যুতার শিকার হয়েছেন, সেই অঞ্চলের জমিদারকে ভুক্তভোগিদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
যদি কোন জমিদার হত্যাকান্ড, দস্যুতা বা শামিত্ম ভংগের কারণ ঘটান বা কারণকে উপেক্ষা করেন তাহলে তাকেও সর্বোচ্চ মৃত্যুদন্ডের শাসিত্ম প্রদান করা হবে। জমিদার মামলার প্রকৃতি অনুযায়ী অন্যান্য সকল অসাদাচরণ জনিত কারণে দায়ী হলে শাসিত্মর সম্মুখীন হবেন। এই অনবদ্য আদেশের ফলে জমিদারগণ বাধ্য হলেন তাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য। নিম্নবর্ণিত এলাকাগুলো থানা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়-
১) ইসাফপুর ও সৈয়দপুর জমিদারির অমত্মর্গত মির্জানগর, মুড়লী, লাকিন্দি, খাজুরা।
২) মুহাম্মদশাহী স্টেটের কালিগঞ্জ ও ঝিনাইদহ (এই দুটো এলাকা ও ভাটিয়াপাড়া
ভূষণা থানার অমত্মর্গত তিনটি চৌকি ছিল।)
৩) শাহজিয়াল এর অমত্মর্গত শামারসদিয়া।
৪) নোয়াবাদ হাবেলী (হোগলা পরগণা), মেহেরপুর (সুলতানপুর পরগনাহ)
মুড়লীসহ থানার সংখ্যা ৫ থেকে ১৩ তে উত্তীর্ণ হয়েছিলো। বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজনীয়তা থেকেই এই পদ্ধতিগত পরিবর্তন এসেছিল। জমিদাররা স্বাভাবিকভাবেই এই খরচ বহন করতে বিরোধিতা করেছিলেন। তবে ম্যাজিস্ট্রেটগণ সদর দপ্তরে ফোর্স মজুদ রাখতে পারতেন। এই ফোর্স তারা যেকোন অভিযানে ব্যবহার করতে পারতেন। থানার সংখ্যা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক সময়ে সময়ে পরিবর্তিত হত। ১৭৯১ সালে ম্যাজিস্ট্রেট থানাসমূহের নিম্নলিখিত লিস্ট প্রদান করেছিলো-
যে থানাগুলো জমিদারের কর্তৃত্বাধীনে ছিলো তা হলো- ধরমপুর, ইছাকাদা (সবচেয়ে পুরাতন চৌকিগুলোর মধ্যে একটা, যা মাগুরার নিকটবর্তী ছিলো), ঝিনাইদাহ, তারাগোনিয়া, মহেশপুর। সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল- ঝিনাইদাহ, নোয়াবাদ। এই তালিকা (যা কিছুটা ত্রম্নটিপূর্ণ হয়ত, কারণ ঝিনাইদাহের নাম দুইবার এসেছে) প্রথম দেখায় মনে হবে যে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। ১৭৮৭ সালে ভূষণা ও শাহজিয়ালের সকল থানাসমূহ নিয়ে রাজশাহীর কাছে হসত্মামত্মর করা হয় এবং ২৪ পরগনার সীমানার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনা হয়।
যে পদ্ধতির দ্বারা পুলিশ ব্যবস্থাকে জমিদারের কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো তা কার্যকরী ছিল ১৭৮২ সাল থেকে ১৭৯১/৯২ সাল পর্যমত্ম, অর্থাৎ লর্ড কর্ণওয়ালিসের প্রশাসনিক সংস্কারের পূর্ব পর্যমত্ম। ম্যাজিস্ট্রেটগণের ক্ষমতা ছিল অস্থায়ী ভিত্তিতে থানাদার বা গিরিদার নিয়োগ প্রদানের। এই ক্ষমতা বলে যশোরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বাসত্মবিকভাবে দুটি সরকারি থানা (ঝিনাইদহ ও নোয়াবাদ) নিজের কর্তৃত্বে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু এই ব্যতিক্রমী কাজের সকল আর্থিক দায়ভার গিয়ে পড়ল জমিদারের উপর। জনাব হেঙ্কেলের মত একজন কর্মতৎপর ও উদ্যমী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্বে থাকার কারণে এই জাতীয় পুলিশ ব্যবস্থায় সাধারণত যে খারাপ বিষয়গুলোর উদ্ভব ঘটে তা কোনভাবেই বেড়ে ওঠার সুযোগ পেল না। তাই এটা জোরের সাথে বলা যায় যে অনেক বছরের পর অনেক অনুশীলনের মাধ্যমে পুলিশ ব্যবস্থা ফৌজদারের আমল থেকে অনেক ভালো অবস্থানে এসেছিলো। এই কার্যক্রমের ভালো দিক হলো সরকার ও তৎকালীন অফিসারগণ বাসত্মবিকভাবে পুলিশের সার্বিক পরিবীক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিজ হাতে নিয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে জমিদারদের অংশগ্রহণ সীমিত রেখেছিলেন।
১৭৮২ সালের জুন মাসের রক্ষণাত্মক ঘোষণাপত্রটা ছিল একটা মৃতপত্র। দস্যুতার ক্ষেত্রে জমিদারদের দায়ভার বহন করার বিষয়টি একদম মারাত্মক ঘটনা ব্যতিত কখনোই প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। শুধুমাত্র যে অংশটুকুর বাসত্মবিক প্রয়োগ ছিল তা হলো জমিদারকে পুলিশ থানা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে বাধ্য করা। এমনকি আদেশের এই অংশটুকুও ঝিনাইদহ ও নোয়াবাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। যখন এমন দুই ব্যক্তিকে কোন যৌথ দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব প্রদান করা হয় যাদের কর্মপন্থা ও স্বার্থ আলাদা; যেমন ম্যাজিস্ট্রেট- একজন কর্মউদ্যমী ব্যক্তি, যিনি যে কোন কাজে অংশগ্রহণ করেন কর্তব্যের খাতিরে, আরেকজন হলেন জমিদার, যিনি যত কম সম্ভব কাজ করতে পছন্দ করেন এবং সর্বদা তার কাজের ফলাফলের ভয়ে ভীত থাকতেন-- এমন দুই ব্যক্তিকে কোন কাজের যৌথ দায়িত্ব দিলে ফলাফল যা হয় তাই হলো ঝিনাইদহ ও নোয়াবাদের ক্ষেত্রে।
জমিদারদের দ্বারা পুলিশ নিয়ন্ত্রণের যে পরিকল্পনাটি ছিল তা ক্রমান্বয়ে ভেসেত্ম গেল। জে ওয়েস্টল্যান্ডের মতে, ‘‘এটা আসলে মুসলিম সরকার যারা সূক্ষ্ম বিষয়গুলোতে নজরে নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং ভাসা ভাসা ফল ছাড়া কিছুই চাইতেননা, তাদের জন্য ঠিক ছিল। কিমত্ম যখন ইংরেজ শাসন জেলায় আসলো তখন তারা একটা নতুন চিমত্মা নিয়ে এলো যে, এই পৃথিবী কোন বিখ্যাত পরিবারের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য তৈরীহয়নি যারা তাদের ইচ্ছা মত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। আর সেইসব ব্যক্তি বিশেষের কাছ থেকে সঠিক নাগরিক দায়িত্ব পালনের বিষয়টি চিমত্মা করা একেবারেই অসম্ভব, যারা এই দায়িত্ব পালনের ফলে কিছুই পাবে না এবং একই সাথে কিছুই হারাবে না।’’ তাই জমিদাররা অত্যমত্ম উৎসাহের সাথে সেই ম্যাজিস্ট্রেটদের কাজে সাহায্য করবে যারা জমিদারদের পূর্ববর্তী দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজের জন্য তাদের ক্ষমতার বিলোপ ঘটিয়েছিলেন, একথা চিমত্মা করা একেবারেই অমূলক। এক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটগণ কাজে বাধাপ্রদানকারী অনেক জমিদারদেরকে বাদ রেখেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটগণ শুধু আশা করতেন জমিদারদের প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে যে আদেশ প্রদান করা হয়েছে তা যেন তারা সঠিকভাবে প্রতিপালন করেন। ঐসময় থেকেই জমিদারদের জনসেবার মাত্রা ক্রমে হ্রাস পেতে লাগলো, এবং তাদের দায়িত্বসমূহের প্রতিপালন নামেমাত্র এসে দাঁড়াল।৭৭
সুন্দরবন পুলিশ
সুন্দরবনের নদীতে টহল বোট প্রদানের বিষয়ে তৎকালীন সরকার পদক্ষেপ নিয়েছিল। পূর্বদিকে অবস্থিত জেলাগুলো থেকে কোলকাতা যাওয়ার পথটি ছিলো কচুয়া থেকে ফকিরহাট পার হয়ে চাঁদখালীর কাছে কাবাদাক ও কালিগঞ্জ পার হয়ে যাওয়ার পথ। তখনকার দিনে একটা বাহিরের দিকের পথও ছিল। কিন্তু পথটি ব্যবহার হত তখনই যখন ভেতরের পথ ব্যবহার করা যেত না। ঐ পথে শুকনা মৌসুমে ১৫০০-২০০০ নৌকা চলাচল করতো।
স্বাভাবিকভাবেই এই নৌ পথটি ছিল দস্যুদের অভয়ারণ্য। মানুষ শুধু সেখানে দস্যুতার জন্যই যেত তা নয়, সাধারণভাবে অনেকে মৎস্যজীবী হিসেবেও যেত, কিন্তু সুযোগ পেলে তারাও দস্যুতার সাথে জড়িয়ে পড়ত। দস্যুতার উপদ্রবে নদী পথটি খুবই বিপদজনক ছিল। তখনকার দিনে এই নৌ পথটি দু’পাশের চাষাবাদকৃত জমি ও গ্রামের মধ্যে ছিলনা, বরং এই পথের দু’পাশে ছিল ঘন বনায়ন ও বসবাসের অনুপযোগী জঙ্গল।
সুন্দরবন সবসময় ছিল ডাকাত ও দস্যুদের অভয়ারণ্য এবং তাদের ধ্বংযজ্ঞ তৎকালীন সরকারের নজরে এসেছিলো। সরকার ম্যাজিস্ট্রেটকে বলেছিলো এই ঘটনা প্রতিরোধে কী কী প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় তার প্রসত্মাব দিতে। ম্যাজিস্ট্রেটের প্রেরিত প্রসত্মাবকে গ্রহণ করেই সরকার ছয়টি গার্ডবোর্টের মাধ্যমে নদীতে টহল পেট্রোল চালু করে জাহাজগুলোকে সুরক্ষা প্রদান করেছিলো। এটা ছিল ১৭৮৮ সালের কথা। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই সরকার খরচের বিষয়টি অনুধাবন করতে লাগলো। তাই খরচের বিষয়টি বিবেচনা করে পূর্বের স্বাভাবিক পরিকল্পনা অনুসারে এই খরচের বোঝা আবারও জমিদারদের কাঁধে চাপানো হলো। সরকার মনে করেছিলো যে জমিদারদের মাধ্যমে সব কিছু করিয়ে নিতে পারবে যা আসলে সরকারের মূল দায়িত্ব ছিল। এই সিদ্ধামেত্মর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন হেঙ্কেল এবং তার আবেদনের প্রেক্ষেতে গার্ডবোর্ট প্রেট্টোল ফোর্স কে যথাস্থানেই রাখা হয়।৭৮
অপরাধের চিত্র
জনাব হেঙ্কেলের চিঠিপত্রের মাধ্যমে তৎকালীন সময়ে জেলার অপরাধ চিত্র ও পুলিশি কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় যেমন-
হীরা সরদারের বাহিনী
জনাব হেঙ্কেলের আগমনের অব্যবহিত পরই তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন যাতে সবচেয়ে উলেখযোগ্য ছিলা হীরা ডাকাতের নাম। হীরা ডাকাত চলিশ মাইল থেকে রায়তদের উপর প্রায়ই তার ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ চালাত। মুর্শিদাবাদের নবাব প্রায়ই আদেশ করতেন হীরা ডাকাতকে গ্রেফতারের জন্য, কিন্তু জমিদারগণ সবসময় তাকে রক্ষা করার জন্য তাকে মৃত বলে ঘোষণা দিতেন। জনাব হেঙ্কেল, জনাব হেভলনের চিঠির মারফত জানতে পেরেছিলেন যে হীরা সর্দার জেলে আটক আছেন। কিন্তু জনাব হেঙ্কেল মনে করছিলেন যে সে (হিরা সর্দার) জেলেও নিরাপদ নয়। সরকারের নিকট থেকে স্থায়ী ভিত্তিতে মিলিটারি ফোর্স প্রদানের প্রতিজ্ঞা তিনি আগেই পেয়েছিলেন; সেই ফোর্স কে তিনি অতিসত্ত্বর মুড়লীতে যোগদান করতে বললেন। তার কাছে সংবাদ ছিল যে খুলনায় ৩০০ জন লোকের একটি দল হীরা সরদারকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করতে জড়ো হ&&চ্ছল। পরবর্তীতে তিনি হীরা সর্দারকে বিচারের সম্মুখীন করার পূর্ব পর্যমত্ম জেলে আটক রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।৭৯
সরকারী কোষাগার লুট
১৭৮৩ সালের জানুয়ারী মাসে ৩,০০০ জন ডাকাতের একটি দল ভূষণা থেকে কোলকাতাগামী ৪০,০০০ (চলিশ হাজার টাকা) বহনকারী একটি সরকারি কনভয়ের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। তারা রক্ষীদলের কিছুলোককে হত্যা করে সম্পদের একটা অংশ লুট করে নিয়ে যায়। মাত্র ৫০ জন লোককে মেদিনীপুরের তুমলোক নামক জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছিল যা পরবর্তিতে ভুল লোক হিসেবে বিবেচিত হয়।৮০
নড়াইলের কালী শংকর
নড়াইল পরিবারের পূর্বপুরম্নষ কালী শংকর দত্ত অথবা রায় ছিলেন এমন একজন মানুষ যার প্রথম আবির্ভাব হয়েছিলো জনাব হেঙ্কেলের লেখা চিঠিতে। যেখানে হেঙ্কেল তাকে ‘একজন ডাকাত ও একজন কুখ্যাত শামিত্ম ভংগকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। কালী শংকর ছিলেন মূলত একজন লাঠিয়াল জমিদার যিনি একজন ডাকাত থেকেও ভয়ংকর ছিলেন।
৮ জুন ১৭৮৪ সালের ঘটনা। ঐ দিন রাতে কালী শংকর তার ভাই নান্দু দত্ত ও আরো সশস্ত্র লোকেরা একত্রেমিলে একটি চালবাহী নৌকাকে আক্রমণ করে মাঝিকে আহত করেছিলো। ঐ লুটেরাদের গ্রেফতার করতে হেঙ্কেল গিরিদোয়ার কুতুবুলvহর নেতৃত্বে একদল সেপাহী প্রেরণ করেছিলেন। এই দলটি নড়াইলে এসেছিলো নড়াইলের পরিবারের একজন গোপন শত্রম্নর সাথে। কালী শংকর সেখানে ১৫০০ লোক তৈরী রেখেছিলেন যুদ্ধ করার জন্য। সে তার লোকদের চারটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এই যুদ্ধ চলেছিলো চার ঘণ্টা যাবত এবং কালী শংকর ঐ দিনের বিজয়ী ছিলেন। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট বাহিনীর দুজনকে হত্যা ও ১৫ জনকে আহত করতে পেরেছিলেন। সেনাপতি কুতুবুলvহ সংঘর্ষে আহত হয়েছিলেন।
এই পরাজয়ের গvনি গ্রহণ করে হেঙ্কেল পুনরায় শক্তি নিয়োগ করেছিলেন এবং ঐকামিত্মক প্রচেষ্টায় নান্দু দত্ত ও অন্যান্য দলীয় প্রধানদের ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু কালী শংকরকে কোথাও পাওয়া যায়নি। সে নাটোরের জমিদারের আশ্রয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। পরবর্তীতে তাকে সরকারের কাছ থেকে হসত্মামত্মরের আদেশ হলে নাটোরের জমিদার তাকে কোলকাতা পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন। কালী শংকর সেখানে নাটোরে জমিদারের এজেন্ট কর্তৃক লুকায়িত ছিলেন। এরপর অনেক কষ্ট ও দীর্ঘসূত্রিতার পরে কালী শংকরের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিলো এবং তাকে গ্রেফতার করে মুড়লীতে ফেরত আনা হয়েছিলো ৪০ জন সিপাহীর প্রহরায়। এটা ছিল ঐ অঞ্চলে শামিত্ম আনয়নের ক্ষেত্রে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ।
স্থানীয়ভাবে জানা যায় যে, কালী শংকরকে পরবর্তিতে দারোগার মাধ্যমে গোপনে বিচার করা হয়। বলা হয় যে, যে অপরাধ কালী শংকর করেছিলেন তা ডাকাতি ছিল না, তা ছিল লুট-তরাজ। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি ধনী ব্যবসায়িক পরিবারকে বিরক্ত করা যার দ্বারা একসময় কালী শংকরের তি হয়েছিল। তারপরও তাকে তার সহযোগীদের নিয়ে এমন সশস্ত্র প্রতিরোধের জন্য শাসিত্ম পেতেই হতো।৮১
জমিদার ও অপরাধীদের মিলন
জনাব হেঙ্কেল ১৭৮৪ সালে ৩০ এপ্রিল অভিযোগ করেছিলেন যে নাটোরের রাজা সঠিকভাবে ভূষণা থানা পরিচালনা করেছেন না এবং যার ফলশ্রম্নতিতে ভূষণা অঞ্চলে ডাকাতির সংখ্যা বেড়ে গিয়েছে। ঠিক একই সময় কালী শংকরের বিষয়টি সামনে চলে আসে এবং একদল সশস্ত্র লোক ভূষণা থানায় আক্রমণ করে আটজন ডাকাতকে ভূষণা থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায় এবং অন্য একটি দল একই সময় ভূষণা এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এ ব্যাপারে নাটোরের জমিদার নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেন।৮২
তৎকালীন যশোরের অপরাধী জাতিসমূহ
যশোরে দু’একটি মাত্র অপরাধী জাতি ছিল। প্রথমটি মূলত বৈদ্য সম্প্রদায়ভুক্ত। ঝিকরগাছা থানায় আদের দেখা মিলত। তারা একটি লুণ্ঠনকারী জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল। কিছু কিছু লোকের কাছে তারা বৈদ্য হিসাবে পরিচিত ছিল যারা সাধারণত কৃষি কাজ করতেন। তবে জীবিকা নির্বাহের জন্য চুরিই ছিল তাদের প্রধান পেশা। রাতের প্রথম প্রহরে তারা বাসায় থাকলেও শেষ রাতে নদীয়ায়, ২৪ পরগনা,হুগলীসহ অন্যান্য জেলায় রাসত্মায় ঘুরে বেড়াতো। গভীর রাতে তারা কোন ঘরের দরজা ভেঙ্গে বাসার মালামাল চুরি করত। চুরির জন্য টাকা ও স্বর্ণালংকারের প্রতি তারা বেশি গুরম্নত্ব দিত। তবে চুরি করা জিনিপত্র বাসায় না রেখে দূরে কোথাও রাখত। অন্য একটা সম্প্রদায়ের নাম উলেখ করার মতন। সবার কাছে পানচাঁচির কায়সত্ম সম্প্রদায়ের একটা আলাদা পরিচিত ছিল। এই সম্প্রদায়ের লোকজন লোহাগড়া থানায় বসবাস করত। তারা নিজেদের খুব পরিপাটি করে সাজিয়ে ঠিক বাবুদের ন্যায় নৌকা বা পায়ে হেঁটে মার্কেটে এবং মেলায় ঘুরে বেড়াত। কোন জুয়েলারি বা বড় কোন কাপড়ের দোকানে তারা দল বেঁধে বাবু সেজে ঢুকত। কোন দ্রব্য দেখতে দেখতে এক হাত থেকে অন্যের হাতে দিত আর এমনি করে কৌশলে জিনিসটা দোকান থেকে সরিয়ে বাইরে নিয়ে আসত। দোকানদারের সাথে দু-একজন কোন একটা দ্রব্য দরদাম করত। তবে দাম তারা এতটাই কম বলত যে দোকানদার দিতে অস্বীকৃতি জানাত এবং ইতিমধ্যে অন্যদের মাল সরানো হয়ে গেলে তারা দোকান থেকে আসেত্ম আসেত্ম কেটে পড়ত। মাঝে মাঝে তারা পোদ্দারের দোকানেও যেত। কোন একটা জিনিস পরিবর্তনের জন্য গিয়ে দোকানদারের সাথে কথা কাটা-কাটি করে অন্য একটা জিনিস নিয়ে সরে পড়ত। যদি দোকানদার বা অন্য কেউ তাদের চোর বলে চিৎকার দিত। তখন তারা চুরি করা জিনিসটা দূরে ছুড়ে ফেলে পাগলের ভান করত। পানচাঁচির কায়স্থদের জীবন যাত্রা উদ্ভট ধরণের ছিল। তারা সচরাচর যৌনকর্মীদের বাসায় যেত এবং যৌনকমীদের মদ পান করিয়ে ডাকাতি করে নিয়ে যেত। তাদের চুরি করার অন্য আরেকটি কৌশল ছিল। তারা মাঝে মাঝে নাপিত সেজে চুল, দাড়ি কাটত তখন সুন্দর সুন্দর গল্প বলত। গল্প শুনে যখন তার কাস্টমার একটু অন্যমনস্ক হত তখনই তাদের দলের কেউ এসে কাস্টমারের রাখা জিনিসপত্র নিয়ে যেত। আবার মাঝে মাঝে মাঝি সেজে নৌকা চুরি করত। তাদের অভ্যাস এতটাই খারাপ ছিল যে হাতের কাছে যা পড়ত তাই চুরি করত বা চুরি করার জন্য মনস্থির করত।৮৩
অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি ও এর প্রতিকার
নাটোরের রাজাই একমাত্র জমিদার ছিলেন না যে বিখ্যাত অপরাধীদের পালানোর বিষয়টিকে উপেক্ষা করতেন। তৎকালীন সময়ে বিষয়টি জমিদারদের খুব সাধারণ কর্মকান্ডে পরিণত হলেছিলো। যার স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবে ঐসব অঞ্চলে অপরাধের প্রবণতা বৃদ্ধি পেল। ১৭৮৫ থেকে ১৭৮৬ এর মধ্যবর্তী সময়ে এ প্রবণতার বৃদ্ধির ফলে অপরাধের মাত্রা ছাড়িয়েছিলো। ১৭৮৬ সালের শেষভাগে মুহম্মদশাহীর কালেক্টর ও সোনাবাড়িয়া বস্ত্র কারখানার রেসিডেন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রায়শই সংগঠিত দস্যুতা ও অসংখ্যা দলভিত্তিক ডাকাতির অভিযোগসহ জমির মালিকেরা চিঠি লিখত। জনাব হেঙ্কেলের এই বিষয়ক পত্রের জবাবটি উলেখযোগ্য। তিনি লিখেছিলেন যে, তিনি একদল সেপাহী পাঠাচ্ছেন দুষ্কৃতিকারীদের ধরতে ও খুঁজে পেতে, একইসাথে সে জমিদারকে সতর্ক করে দিচ্ছেন যেন তারা তাদের অঞ্চলের সকল দস্যুতার তথ্য তাকে সঠিকভাবে প্রদান করে। জনাব হেঙ্কেল রেসিডেন্টনিকট একজন মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ডাকাতকে এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছিলেন যেন তাকে ফ্যাক্টোরির আশেপাশে কোন দৃষ্টিগোচর এলাকায় দড়িতে ঝুলিয়ে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। তার ধারনা ছিল অন্যান্য ডাকাতদের মাঝে এর ফলে আতংক সৃষ্টি হবে। ১৭৮৮ সালের একটি ঘটনা বর্ণনা করলে এসময়ে ডাকাতদের সাহসীকতার একটি নিদর্শন পাওয়া যায়। ঐ বছরের অক্টোবর মাসে একদল ডাকাত একটি বোট আক্রমণ করে। ঐ বোটে আটজন সিপাহী ও একজন নায়েক ছিলেন। ঐ ৮ জনের মধ্যে থেকে তিন জনকে পানিতে ফেলে দেয়া হয় এবং তারা ডুবে মারা যায়। তারপর ডাকাতেরা ডাকাতি করে সরে পড়ে।৮৪
পুলিশ স্টেশন
পুলিশদের ক্ষেত্রে থানা ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়েছিল। সরকারের মতামত ছিল পুলিশ স্টেশনগুলোর একটি থেকে অন্যটি ২০ মাইল দূরে অবস্থিত হবে। মি. রকের প্রসত্মাব অনুযায়ী দেখা গিয়েছিল যে, একটা জেলায় দশটি থানা স্থাপনই যথেষ্ট। কিন্তু ১৭৯৪ সালের শুমারিতে সর্বমোট ১৯টি থানা দেখা যায়। থানাগুলোর মধ্যে যশোর স্টেশনে মাসে খরচ ছিলো ৫৬ রম্নপি এবং বাকিগুলোর মধ্যে একটায় ৯০ রম্নপি এবং অন্য ১৭ টায় মাসে ৫৬ রম্নপি খরচ হতো। এছাড়া পাহারা, নৌকার স্থাপনা এবং এর ব্যবস্থাপনা বাবদ মাসে খরচ হতো ২,০২৮ রম্নপি। একটি লক্ষনীয় বিষয়ে যে, ১৭৯৪ সালে শুধু একজন থানার দারোগা ছিলেন হিন্দু এবং বাকি সবাই মুসলমান। কিন্তু ১৮৪৩ সালে আমরা এর বিপরীত চিত্র দেখতে পায়। তখনকার সময় বারজন দারোগার মধ্যে দশজন ছিলেন হিন্দু এবং অন্য দুই জন ছিলেন মুসলমান।৮৫
পুলিশ ট্যাক্স
এই সমসত্ম প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যয় নির্বাহের জন্য বণিক, ব্যবসায়ী এবং দোকাদদারদের উপর ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছিল এবং তারা তা দিতে বাধ্য ছিলেন। কালেক্টর দ্বারা নিয়োগপ্রাপ্ত আমীন এই ট্যাক্স ধার্য করতেন। যারা ট্যাক্স দিতে বাধ্য আমীনরা তাদের সম্পদের উপর ট্যাক্স নির্ধারণ করতেন। তাদের আয়ের উপর ট্যাক্স নির্ধারিত হতো না। একটি নির্দিষ্ট হারে সমসত্ম ট্যাক্স আদায়ের জন্য ট্যাক্স আদায়ের হার ও সময় নির্ধারন করে দেওয়া হতো। আমীনরা ব্যবসায়ীদের সম্পত্তি হিসাব করে মোট ৮৯,০০০ রম্নপি সমসত্ম জেলা থেকে আদায় করেছিলেন। এরমধ্যে ট্যাক্স আদায় হলো ২৫,০০০ থেকে ৩০,০০০ রম্নপি। ট্যাক্সের এই মোট পরিমাণ বৃদ্ধি করা অনেক কঠিন কাজ ছিল কারণ যশোরে গরীব মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল। অন্য একটা কারণ হতে পারে- ট্যাক্স আদায় কজে নিয়োজিত আমীনদের দুর্নীতি। যাদের উপর ট্যাক্স ধার্য করা হয়েছে তাদের সংখ্যাও সঠিকভাবে পাওয়া যায়নি। প্রতিটি জেলার খরচের হিসাব অনুযায়ী ট্যাক্সের পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। অন্য কিছু জেলায় অসামঞ্জস্যভাবে ট্যাক্সের পরিমাণ কমে যায়। বর্ধমান ছিল তখনকার মধ্যে তুলনামূলকভাবে সম্পদশালী জেলা। বণিকদের সম্পদের ১ শতাংশ ট্যাক্স আদায় করলেই বর্ধমান জেলার চলত কিন্তু কালেক্টরের হিসাব অনুযায়ী যশোরে ৮.৫০% ট্যাক্স দরকার ছিল। বণিকরা ট্যাক্সের অসমতা দেখে দাবী তুলল যে অন্য জেলার মানুষরা বেশি সুবিধা পাচ্ছে এবং সাথে সাথে তারা তাদের প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখতে পারছে। অন্যান্য জেলার চেয়ে যশোর জেলায় পাহারা নৌকাগুলো ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বেশি দরকার ছিল। তাছাড়া বণিকেরা সবক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করের ব্যাপারে আপত্তি তুলেছিল এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণ টোল আদায়ের ব্যাপারেও তাদের অনেক আপত্তি ছিল। কালেক্টর পরোক্ষ করের ক্ষেত্রগুলোতে প্রত্যক্ষ কর আরোপের পরীক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। যার ফলে যারা সবসময় প্রত্যক্ষ কর দিচ্ছেন তাদের জন্য পরোক্ষ কর বড় বোঝা হয়ে দেখা দিল। প্রত্যক্ষ করারোপের এই পদ্ধতি সফলতা লাভ করেনি এবং সরকার এই করারোপ কয়েক বছর চালানোর পর উঠিয়ে দিলেন।৮৬
১৯১০ সালের পুলিশ ব্যবস্থা
১৯১০ সালে যশোর জেলায় ১৭টি থানা এবং ২৬টি পুলিশ স্টেশন ছিল। আমরিতা বাজারে পুলিশের একটা কাস্টডিয়ান ছিল। বৈদ্যদের অপরাধ নির্মূলের জন্যই সেটা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। পাঁচচরেও পুলিশের একটা কন্ট্রোল রম্নম ছিল। নদীর মধ্যে সংঘটিত অপরাধ দমন এবং অপরাধীদের আটক করার জন্য নদীতেও একটা পাহারা চৌকি স্থাপন করেছিল। ১৯১০ সালে সুপারিনটেনডেন্ট এর অধীনে ৭ জন ইন্সপেক্টর, ৫৫ জন সাব-ইন্সপেক্টর, ৫৬ জন হেড-কনস্টাবল এবং ৪২৫ জন কনস্টাবল নিয়ে একটা পুলিশ ফোর্স গঠন করা হয়। পুলিশ ফোর্সের শক্তি তেমন ছিল না। ৫.৪ কিলোমিটার এলাকায় ৩,২৩২ জন লোকের জন্য একজন পুলিশ নিয়োজিত ছিল। মিউনিসিপালিটিতে টাউন পুলিশের একটা ইউনিট ছিল। একেবারে গ্রামের প্রত্যমত্ম অঞ্চলের জন্য ঐ বছরই ২৫০ জন দফাদার এবং ৩,৪০১ জন চৌকিদার নিয়ে গ্রাম পুলিশ গঠন করা হয়। ফৌজদারী কার্যবিধির আওতায় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। পঞ্চয়েত প্রধানকে ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল।৮৭
১৯৭৯ সালের পুলিশ প্রশাসন
১৯৭৯ সালে জেলার পুলিশ প্রশাসনের প্রধান হলেন পুলিশ সুপার, যিনি জেলার সার্বিক আইন শৃঙখলা বিষয়টি তদারকি করেন। তাকে সহযোগিতা করার জন্য রয়েছে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, তিনজন ডেপুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট অব পুলিশ, নয়জন ইন্সপেক্টর, ৯৩ জন সাব-ইন্সপেক্টর এবং ৬৩ জন সহকারী সাব-ইন্সপেক্টর। জেলার সমগ্র পুলিশ ফোর্সের উপর জেলা প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণ এবং নির্দেশনা থাকত। জেলার পুলিশ প্রশাসনকে পাঁচটি সার্কেলে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সার্কেলের প্রধান নিযুক্ত হন একজন সার্কেল ইন্সপেক্টর। এ সার্কেলগুলো হল- ঝধফধৎ 'অ' সার্কেল যার অধীনে ছিল কোতয়ালী, ঝিকরগাছা এবং শার্শা পুলিশ স্টেশন; ঝধফধৎ 'ই' সার্কেল যার অধীনে ছিল কেশবপুর মনিরামপুর, বাঘারপাড়া এবং অভয়নগর পুলিশ স্টেশন বাকী সার্কেলগুলো হল ঝিনাইদহ, মাগুরা এবং নড়াইল। এছাড়া যশোর জেলাতে ২০টি পুলিশ স্টেশন ছিল। এগুলো হল-
১) কোতয়ালী১৬৮ বর্গমাইল
২) ঝিকরগাছা ১৬০ বর্গমাইল
৩) শার্শা ১৩২ বর্গমাইল
৪) মনিরামপুর ১৭২ বর্গমাইল
৫) কেশবপুর১০০ বর্গমাইল
৬) বাঘারপাড়া ১০৫ বর্গমাইল
৭) অভয়নগর৯৫ বর্গমাইল
৮) ঝিনাইদহ১৮২ বর্গমাইল
৯) শৈলকূপা ১৪৪ বর্গমাইল
১০) কালিগঞ্জ ১৪৮ বর্গমাইল
১১) কোটচাঁদপুর ৬৬ বর্গমাইল
১২) মহেশপুর ২০০ বর্গমাইল
১৩) হরিণাকুন্ডু৮৮ বর্গমাইল
১৪) মাগুরা ১৫৫ বর্গমাইল
১৫) শ্রীপুর ৭১ বর্গমাইল
১৬) মোহাম্মদপুর ৯০ বর্গমাইল
১৭) শালিখা ৮৮ বর্গমাইল
১৮) নড়াইল ১৪৯ বর্গমাইল
১৯) লোহাগড়া ১১৬ বর্গমাইল
২০) কালিয়া ১১৮ বর্গমাইল ৮৮
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস