বিখ্যাত জমিদারগণ ও জমিদারি প্রশাসন
ইসাফপুর জমিদারি
যশোর জেলাটি প্রধানত তিন চারটি জমিদারিতে বিভক্ত ছিল। পূর্বে অবস্থিত ভৈরব ও পশার এর মধ্যবর্তী অঞ্চলের পুরোটাই এবং পশ্চিমে ইছামতি পর্যন্ত বিস্তৃর্ণ প্রায় সমগ্র অঞ্চল নিয়ে ছিল ইসাফপুর জমিদারি। এর জমিদার ছিলেন রাজা শ্রীকান্ত রায়। যে রাজপথটি কোলকাতা হয়ে যশোরে এসে ঢাকা পর্যন্ত চলে গিয়েছে তার কাছাকাছি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তার জমিদারির উত্তরের সীমানা। এই স্টেটকে বলা হতো ইসাফপুর জমিদারি।
সৈয়দপুর জমিদারি
ইসাফপুর জমিদারিটি ছিল আসল জমিদারির বারো আনা। আর বাকি চার আনা বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। একজন মুসলিম জমিদারের নিকট তা হস্তান্তর করা হয়। এই বিচ্ছিন্ন অংশ মূলত সৈয়দপুর ও সাহাশ পরগানা নিয়ে গঠিত। এই স্টেটের নাম পরবর্তীতে সৈয়দপুর নামে নামকরণ করা হয়।
মোহাম্মাদশাহী স্টেট
যে সীমানাটির কথা এতক্ষণ বলা হলো সেই সৈয়দপুর জমিদারির ঠিক উত্তরে অবস্থিত ছিল মোহাম্মদশাহী স্টেট। এই স্টেটটি নলডাংগা পরিবারের অধীনে ছিল। মানচিত্রে এর পরিসীমা কিছুটা কাকতালীয়ভাবে সেইসব অঞ্চলের সাথে দেখানো হয়েছে যা এখনও মোহাম্মদদশাহী পরগনা নামে পরিচিত।
ভূষণা জমিদারি
এরপর সবচেয়ে বিখ্যাত জমিদারি হলো ‘ভূষণা জমিদারি’, যা নাটোরের রাজার রাজত্বের একটি অংশ ছিল। ভূষণা জমিদারি তখনকার দিনে কেবল বর্তমান ফরিদপুর জেলাকেই অন্তর্ভূক্ত করেনি বরং বর্তমান যশোরের উত্তর-পূর্বের নলদি পরগনা, সাতর ও মুকিমপুর পরগনাকে অন্তর্ভূক্ত করেছিলো। যদিও ভূষণা ছিল নাটোর রাজার অধিকৃত অঞ্চলের একটি অংশ, তবুও এটিকে একটি স্বতন্ত্র জমিদারি হিসেবে সবসময় গণ্য করা হতো।৩৯
অন্যান্য কতিপয় ক্ষুদ্র জমিদারি
এসব বড় ও বিখ্যাত জমিদারিগুলো ছাড়াও এ জেলায় কিছু ক্ষুদ্র জমিদারি ছিল। হোগলা ও বেলফুলিয়া পরগনা এসবের মধ্যে কিছুটা বড় জমিদারি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। জমিদার কৃষ্ণসিংহ রায় এখানকার জমিদার ছিলেন, যার উত্তরাধিকারীরা পরবর্তী সময়ে জমিদারি ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব কলহে জড়িয়ে পরার ঘটনা ব্যতিরেকে এই পরিবার সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি।
জমিদারি কতৃত্বের ধরণ
সেলিমবাদ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জমিদারির সাথে আরেকটি জমিদারির নাম উল্লেখ করতে হয়। এ জমিদারিটি হল সুলতানপুর জমিদারি। কাশিনাথ দত্ত ছিলেন ঐ জমিদারির জমিদার। সুলতানপুরের তৎকালীন জমিদার দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়লে কাশিনাথ দত্ত নামক এক ব্যক্তি সমস্ত দেনা পরিশোধ করেন এবং ১৭৭৪ সালে রাজস্ব কমিটির প্রস্তাব মতে ঐ অঞ্চলের জমিদারি লাভ করেন। এর ফলশ্রুতিতে তাকে সেই স্টেটের তের আনা সম্পত্তি অধিকার দেয়া হয়েছিল। চাঁচড়ার রাজ পরিবারের ইতিহাস থেকে এরকম বহু দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ করা যায় যেখানে শাসক শ্রেণী খাজনা প্রদানে ব্যর্থ জমিদারের নিকট হতে সম্পূর্ণ আগন্তকের নিকট শুধুমাত্র দেনা পরিশোধের শর্তে স্টেটের মালিকানা পরিবর্তন করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে বৃটিশ সরকার এ বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করেছিলেন।
বৃহৎ ও ক্ষুদ্র জমিদারির মধ্যে পার্থক্য
যে সকল জমিদারির কথা উলেলখিত হলো তা এই জেলার প্রায় সমস্ত অঞ্চল নিয়ে বিস্তৃত থাকলেও আরো অনেক ক্ষুদ্র জমিদারি এই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় এদেশে মোট জমিদারির সংখ্যা ছিল ১০০টিরও বেশি। কিন্তু বড় জমিদারির বৈশিষ্ট্য ও মালিকানাগত অবস্থান ছিল ছোটগুলোর থেকে আলাদা। এ কথাটি এখানে বলা যায় যে ক্ষুদ্র জমিদারিগুলো ছিল বড় কোন স্বতন্ত্র স্টেটের নিকট হতে ক্রয়কৃত বা দানকৃত আলাদা অংশ। বৃহৎ জমিদারগণের এই দেশের প্রশাসন ব্যবস্থায় একটা অংশগ্রহণ ছিল যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারদের বেলায় কার্যকর ছিল না।
জমিদারগণ রাজস্ব আয়ের জন্য চুক্তিভিত্তিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ছিলেন
কাশিনাথ রায়ের জমিদারি অর্জনের ঘটনাটি একটি বিতর্কের জন্ম দেয়। এ বিতর্কটি হল যে, জমিদাররা কি স্টেটের আসল মালিক হিসেবে সরকারকে রাজস্ব প্রদান করতেন নাকি তারা ছিলেন কেবল রাজস্ব আয়ের জন্য চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ। চাঁচড়া রাজপরিবারের একটি ঘটনা জমিদারদের অবস্থান সম্পর্কে দ্বিতীয় ধারণার সত্যতাকে সমর্থন করে। চাঁচড়া রাজপরিবারের বংশধরদের মধ্যে একজন ছিলেন মনোহর রায়, যিনি শুধুমাত্র নবাবের সথে তার স্টেটের রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়ে ব্যস্ত ছিলেন না বরং তার প্রতিবেশী ছোট ছোট স্টেটেরও রাজস্ব সংগ্রহ করে দিতেন যাদের সাথে তার পূর্ববর্তী কোন সম্পর্ক ছিল না।
জমিদারদের প্রশাসনিক ক্ষমতা ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতা
জমিদারগণ চুক্তিভিত্তিকভাবে শুধু ভূমি রাজস্ব নয় বরং অন্যান্য রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। এ বিষয়ে প্রশাসন তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করতেন। তারা আবগারী রাজস্ব হিসেবে নির্দিষ্ট পরিমাণে রাজস্ব প্রদান করতেন এবং তারা তাদের কর্তৃত্বাধীন এলাকায় নিজেদের খুশিমত আবগারী জমা করতেন। তারা আভ্যন্তরীণ ব্যবসার মাধ্যমে সরকারকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে শুল্ক দিতেন, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের নিকট হতে তারা তাদের ইচ্ছেমত শুল্ক আদায় করতেন। পুলিশের দায়িত্বভার তাদের উপর ন্যাস্ত ছিল এবং পুলিশ ব্যবস্থাকে তারা প্রতিপালন করতেন। তাদের অধিক্ষেত্রে কেউ যদি ডাকাতির কবলে পড়ত, তাহলে জমিদারগণ তার সকল ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকতেন। কিন্তু এই চুক্তির ধারাটি বাস্তবায়নে বৃটিশ সরকার এমনকি তৎকালীন মুসলিম শাসকগণ শক্তভাবে অবস্থান নিয়ে জমিদারদেরকে বাধ্য করতে পারেননি। জমিদারগণ ও তাদের অধীনস্থরা ছোটখাট দেওয়ানী ও ফৌজদারী বিরোধ মিমাংসায় বিচারকের দায়িত্বও পালন করতেন।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস